চাহিদার তুলনায় ত্রাণ কম বিপাকে নিম্নআয়ের মানুষ

প্রকাশ | ১৯ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
ত্রাণের অপেক্ষায় কয়েকজন নারী
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে রাজধানীসহ সারাদেশ চলছে লকডাউন। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। এ ক্ষেত্রে দিনমজুর, শ্রমিকসহ নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছেন বিপাকে। তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ শুরু হলেও স্বজনপ্রীতি, সমন্বয়হীনতা, বিশৃঙ্খলা এবং অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম তদারকি করতে ৫৫ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়াসহ তালিকা করে কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবেন তারা। এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ত্রাণ বিতরণের সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয় না থাকায় ত্রাণ চুরির মতো ঘটনা ঘটেছে, যা দুর্যোগ মোকাবিলাকে আরও জটিল করে দিচ্ছে। ত্রাণও প্রয়োজনের তুলনায় কম। কিছু কিছু এলাকায় এখনো ত্রাণ বিতরণ শুরুই হয়নি। এ জন্য সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসতে হবে। রাজধানীর দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এনজিও এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও দেখা গেছে নিজেদের ইচ্ছামতো ত্রাণ বিতরণ করতে। আবার অনেক স্থানে জনপ্রতিনিধিদের দেখাও মিলছে না। সিটি করপোরেশনের চাহিদা মতো ৫০০ পরিবারের নামের তালিকা জমা দেয়া হলেও অনেক কাউন্সিলর এ পর্যন্ত কোনো ত্রাণ বরাদ্দ পাননি। আর যেসব ওয়ার্ডে ত্রাণ পৌঁছেছে, সেটাও প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। ফলে স্থানীয় দরিদ্র মানুষ তাদের ভুল বুঝছেন। স্থানীয় নিম্ন আয়ের মানুষরা প্রতিদিনই ত্রাণের জন্য ভিড় করছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যতটুকু সম্ভব ত্রাণ দিয়ে সহায়তা করছেন অনেক কাউন্সিলর। অনেক এলাকায় ভোটার না হলে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে না। অনেকে আবার একাধিকবার ত্রাণ পাচ্ছেন। এতে ত্রাণ বিতরণে স্বজনপ্রীতি ও সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণ রোধে মানুষে মানুষে দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। অথচ ত্রাণ বিতরণকালে অধিকাংশ স্থানেই এটি উপেক্ষিত হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. সাঈদ খোকন বলেন, আমরা সবকটি ওয়ার্ডে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে ৭০ শতাংশ ওয়ার্ডে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। বাকি ওয়ার্ডগুলোতেও শিগগিরই পৌঁছে দেয়া হবে। সরকারের তরফ থেকে যে পরিমাণ ত্রাণ দিচ্ছে, সেটা সামান্য। কোটি মানুষের শহরে ৩৫০ মেট্রিকটন চালে কী হবে। তিনি বলেন, ত্রাণ বিতরণে আমাদের একটি কমিটি রয়েছে। সেখানে কমিশনারসহ সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা রয়েছেন, তারা বিষয়টি মনিটরিং করছেন। আমাদের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে স্বজনপ্রীতি, বিশৃঙ্খলা বা একই ব্যক্তিকে বারবার দেয়ার মতো কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য স্থানীয়ভাবে বলা হয়েছে। মাইকিং করা হচ্ছে। রাস্তাগুলোতে প্রতিদিন বিস্নচিং পানি ছিটানো হচ্ছে। দক্ষিণ সিটি মেয়র বলেন, আমরা প্রতি ওয়ার্ডে ৫০০ করে মোট ৫০ হাজার পরিবারকে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছি। এখানে ঢাকার ভোটার হতে হবে- এমন কোনো বিষয় নেই। তবে তাকে অবশ্যই দুস্থ অসহায় দরিদ্র হতে হবে। আমরা ত্রাণ হিসেবে ১০ কেজি চাল, দুই কেজি ডাল, দুই লিটার তেল, এক কেজি লবণ, পাঁচ কেজি আলু ও দুই কেজি পেঁয়াজ দিচ্ছি। এগুলো দিয়ে তিন জনের একটি পরিবারের ২৫ দিন চলে যাবে। এ ছাড়া আমাদের হটলাইনে প্রতিদিন ১২০০-১৫০০ ফোন পাই। সবাইকে তো দেয়া সম্ভব হয় না। প্রতিদিন আমরা ৩৫০ পরিবারকে ত্রাণ দিচ্ছি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এটা সত্য যে, প্রথম দিকে ত্রাণ কার্যক্রমে কিছু সমন্বয়হীনতা ছিল। কিন্তু এখন তালিকা করে ত্রাণ দিতে বলেছি। প্রত্যেক কাউন্সিলর ৫০০ জনের তালিকা দিয়েছেন। সবাই যেন সমানভাবে পায়, সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা মেনে ঘরে ঘরে ত্রাণ দেয়া কঠিন বলে মনে করেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি বলেন, কাউন্সিলররা যদি প্রধানমন্ত্রী নির্দেশিত নিয়মের ব্যতয় ঘটান, তাহলে অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেব। আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা চাহিদা মতো ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছি। প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও প্রক্রিয়া চলমান থাকলে ত্রাণ কার্যক্রম আমরা চালিয়ে যেতে পারব। এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. শাহ আলম বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ত্রাণ নিয়ে কোনো অনিয়ম হয়নি, কোথাও একটা মামলাও হয়নি। ডিসি, ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের নিয়ে কমিটির মাধ্যমে তালিকা করে ঘরে ঘরে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। আমাদের কোনো টাকার লেনদেন ও ডিলার নেই। ওএমএস ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে কিছু অনিয়ম দেখা গেছে। সে জন্য সরকার নতুন করে দরিদ্র ৫০ লাখ পরিবারকে রেশন কার্ডের মাধ্যমে ত্রাণ দেবে। যারা বাদ পড়বে, তাদের কার্ড করে ত্রাণ দেয়া হবে। এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নেয়ার প্রয়োজন নেই। ফলে করোনার প্রকোপ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তিনি বলেন, করোনার কারণে সাধারণ ছুটি থাকায় মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। মানুষের ঘরে খাদ্যের সংকট দেখা দিচ্ছে। প্রথমে যা ছিল এখন ছুটি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা বাড়ছে। ফলে আমাদের কার্যক্রমের আওতাও আস্তে আস্তে বাড়াতে হচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন লোক যুক্ত হচ্ছে। মানুষের অভাব অফুরন্ত। চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত না দিতে পারলেও আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে যাচ্ছি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে প্রতি সপ্তাহে ৩৫০ টন করে মোট ৭০০ টন ত্রাণ দেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম শাহীন খান বলেন, ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় থাকা যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলারই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে সেটা প্রায়ই দেখা যায় না। যে যার মতো ত্রাণ দিচ্ছেন। এতে অনেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন। এ জন্য ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করেও আমরা সমাধান পেতে পারি। ত্রাণ বিতরণ সঠিকভাবে না হলে অভাবী মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। এতে দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ত্রাণ বিতরণ সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় জেলা প্রশাসনকে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে এই ত্রাণ বিতরণ করা হবে। এ জন্য অগ্রাধিকার তালিকা করতে বলা হয়েছে কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের। স্থানীয় পর্যায়ে বিত্তশালী কোনো ব্যক্তি বা কোনো বেসরকারি সংস্থা ত্রাণ সহায়তা দিতে চাইলে জেলা প্রশাসকের তালিকার সঙ্গে সমন্বয় করতে বলা হয়েছে, যেন দ্বৈততা এড়ানো যায় এবং যথাবণ্টন হয়। নিরাপদ দূরত্ব রেখে, প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ বিতরণের কথা বলা হয় নির্দেশনায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেসব মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বেশ কয়েকটি স্থানে দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান-মেম্বার ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে ত্রাণ তছরুপের। এ ছাড়া ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রির চালও গায়েব করে ফেলার অভিযোগ রয়েছে অনেক ডিলারের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন ডিলারকে এবং ত্রাণ বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে। উলেস্নখ্য, করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে ছুটি ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে আরোপ করা হয় বেশ কিছু বিধি-নিষেধ। এরপরই কার্যত লকডাউন হয়ে যায় পুরো দেশ; কর্মহীন হয়ে পড়েন অসংখ্য মানুষ। বিশেষ করে রোজকার শ্রমে-ঘামে চলে যাদের যাপিত জীবন, তারা আছেন খুবই দুর্দশায়। কর্মহীনদের তাৎক্ষণিক মানবিক সহায়তা দিতে চার দফায় ২২ কোটি ১৫ লাখ ৭২ হাজার ২৬৪ টাকা এবং ৭৬ হাজার মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরের চালও দেয়া হচ্ছে।