অপরাধী
প্রকাশ | ১৭ মে ২০২৪, ০০:০০

দীনার টেস্ট পরীক্ষা চলছে। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার দিন বাসা থেকে বের হতে তার একটু দেরি হয়ে গেল। কারণ, পড়া ছেড়ে উঠতে দেরি করে ফেলেছে। মা বারবার তাগিদ দিয়েছেন- 'তাড়াতাড়ি তৈরি হ', সময় হয়ে যাচ্ছে।' কিন্তু সে আর একটু, আর একটু করে দেরি করে ফেলেছে। স্কুল কাছে বলে সে একাই স্কুলে আসা-যাওয়া করে। ক্লাশ এইট পর্যন্ত মা সঙ্গে ছিলেন। তারপর থেকে সে আর সঙ্গীর প্রয়োজন বোধ করেনি। সাড়ে ৯টায় সে বাসা থেকে বের হলো। এই ট্রাফিক জ্যামের শহরে জরুরি প্রয়োজনে মাত্র আধাঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে বের হওয়া ঠিক নয়- যদিও তার স্কুল রিকশা করে পনের মিনিটের পথ। মোড়ে এসে সে দেখে রিকশা পাওয়া কঠিন। যে রিকশাওয়ালাকেই তার স্কুলের কথা বলে সেই রিকশাওয়ালাই বলে- 'ওদিকে যামু না।' -ভাড়া বাড়িয়েম দেব। -একশ' ট্যাকা দিলেও যামু না। কেন যেতে চায় না দীনা তা বোঝে। পরীক্ষার সময় স্কুলের দিকে জ্যাম বেশি থাকে। দীনার উদ্বিগ্নতা বেড়ে যাচ্ছে। যাত্রী নিয়ে গেলেও ফেরার সময় যাত্রী পাওয়া যায় না। এমন সময় সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল একজন। তার নাম পাভেল। সে বসে ছিল পাশের ক্লাব ঘরটার বারান্দায়। সে বোধ হয় আগে থেকেই দীনাকে লক্ষ্য করছিল। সে এগিয়ে এসে বলল-'রিকশা পাচ্ছো না বুঝি?' দীনা চমকে উঠে একটু পিছিয়ে গেল। পাভেলকে দেখে এলাকার সবাই চমকে উঠে। সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে চায়। সে পাভেলের প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পাচ্ছিল না। পাভেল আরও একটু এগিয়ে এসে কণ্ঠটাকে আরও নরম করে বলল- 'তোমার তো পরীক্ষা। দেরি হয়ে যাচ্ছে?' -'জি।' -'কোনো রিকশা কি যেতে চাচ্ছে না?' -'জ্বি না।' -'দাঁড়াও, আমি দেখছি.......।' পাভেল এক রিকশাওয়ালাকে বলল- 'ভাই, মেয়েটার পরীক্ষা। যেন-তেন পরীক্ষা না-টেস্ট পরীক্ষা। ফেল করলে ডিসঅ্যালাও। এবার আর এসএসসি দিতে পারবে না। বিরাট লস হয়ে যাবে। লস হলেই ক্ষতি। দয়া করে একটু নিয়ে যান। ভাড়া না হয় একটু বেশিই নিয়েন। বোঝেন তো লেট করলেই দেরি হয়ে যাবে।' সেই রিকশাওয়ালা যেতে রাজি হলো। দীনা রিকশায় উঠল। পাভেল বলল- 'টেনশন নিও না। একটু লেট হলেও মাথা ঠান্ডা রেখে পরীক্ষা দিও।' -'থ্যাঙ্ক ইউ ভাইয়া।' -'ওয়েলকাম।' রিকশায় বসে দীনা পরীক্ষার কথা ভুলে গেল। ভাবতে লাগল পাভেলের কথা। সবাই তাকে খারাপ ছেলে বলে। তবে সবার সঙ্গে সে খারাপ ব্যবহার করে না নিশ্চয়। না হলে এখন এমন চমৎকার ব্যবহার করতে পারত না। তার সাহায্য না পেলে আজ যথাসময়ে পরীক্ষার কক্ষে যেতেই পারত না। **** পরের পরীক্ষায় দীনা বেশ আগেই বের হলো। তখন রিকশাও ছিল যথেষ্ট। বলা মাত্রই একজন রিকশাওয়ালা রাজি হয়ে গেল। কারো সাহায্যের দরকার ছিল না দীনার। তারপরও পাভেল এগিয়ে এলো। বলল, 'রিকশা পেয়েছ?' দীনা হাসি মুখে বলল-'জ্বি ভাইয়া, পেয়েছি।' -'আজ কী পরীক্ষা?' -'ফিজিক্স।' -'ফিজিক্স যেন কোনো সাবজেক্ট?' -'পদার্থ বিজ্ঞান।' -'ও বিজ্ঞান? বিজ্ঞানে তো এই দ্যাশের পোলাপান বরাবরই অজ্ঞান। পোলাপানের কোনো দোষ নেই। দোষ কার জানো? যারা শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করে তাগো দোষ। মাদ্রাসা লাইনের পোলাপান তো বিজ্ঞানকে হারাম বানায়া রাখছে। ওরা বিজ্ঞান, গণিত, ইংরেজি, ইতিহাস, পাতিহাঁস এ সবকিছুই জানে না।' -'হি হি হি।' -'হাসছো যে?' -'পাতিহাঁস কী ভাইয়া?' -'পাতিহাঁস বলেছি? আরে পলিটিক্স করি তো, মাথা আওলা থাকে।' -'আসি ভাইয়া।' -'আর এর মধ্যেও একটা পলিটিক্স আছে। এই দ্যাশে সবকিছুতেই পলিটিক্স। মাদ্রাসায় বিজ্ঞান, গণিত, ইংরেজি, ইতিহাস, পাতিহাঁস ঢুকাইতে গেলে দ্যাশে রোল উঠবো- এই যে, সরকার দ্যাশ থিকা ধর্ম বাদ দিতে চাইতেছে। এইটা নাস্তিক সরকার। তখন দলের ভোট কমে যাবে। ভোটের রাজনীতি বড়ই জটিল। এই জটিল রাজনীতিতে পড়ে মাদ্রাসার গরিব মানুষের পোলাপানগুলা গরিব হয়েই থাকল, মাথা উঁচা করে দাঁড়ানোর মতো শিক্ষা পাইল না।' -'ভাইয়া.......।' -'আর জেনারেল লাইনের পোলাপান.......। কী যেন শিক্ষা পদ্ধতি বর্তমানে?' -'সৃজনশীল।' -'ও হঁ্যা, এই আজাইরা পদ্ধতিতে লেখাপড়া কইরা বিজ্ঞান বোঝা যাইব? আমাদের কপাল মন্দ। সারা জীবন ইউরোপ-আমেরিকার বিজ্ঞানীদের ওপরই আমাদের নির্ভর করতে হবে।' -'আসি ভাইয়া।' -'আমার বিশ্বাস তুমি বিজ্ঞানে ভালো করবা। একজন মহিলা বিজ্ঞানী হইতে পারবা। তবে তখন ইউরোপ-আমেরিকায় চলে যেতে হবে। এই দেশে থেকে বিজ্ঞানের আলোকে কিছু ব্যাখ্যা করতে গেলে নাস্তিক হয়ে যাবা। তখন আবার কোপ-টোপ খাইতে পার।' -'ভাইয়া আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।' -'ওই যে হুইল চেয়ারে সেট-আপ বিজ্ঞানীটার নাম যেন কী?' -'স্টিফেন হকিং।' -'হঁ্যা হঁ্যা, ওই হকিং সাহেব হুইল চেয়ারে বইসা যে সব থিওরি দিতেছে, সে সব যদি বাংলাদেশের কেউ দিত তাহলে তারে তো কাটতো কাটতোই, তার হুইল চেয়ারও কাইটা ফেলত। তখন ক্ষমতাসীনরা বলত- ৯০% মসুলমানের দেশে ওরকম থিওরি দেয়ার দরকার কী? ওই বিজ্ঞানীর পাসে সরকার দাঁড়াবে না।' -'তাহলে তো আমাদের রাজনীতি একটা নষ্ট রাজনীতি।' -'নষ্টই তো। নষ্ট-পচা-দুর্গন্ধযুক্ত এই পলিটিক্স। এই আমাকে দেখ, ক্লাশ নাইন পর্যন্ত আমি ক্লাশে ফার্স্ট ছিলাম। নাইন-এ উঠে আমি পলিটিক্স-এ ঢুকলাম। আর তখনই আমি নষ্ট হয়ে গেলাম- পচে গেলাম। এখন আমার কাছ থেকে দুর্গন্ধ ছোটে। সবাই ভয় পায় সেই দুর্গন্ধ। আমিও পাই। তুমি এখন পাইতেছো না?' -'আসি ভাইয়া....।' -'ঠিকই পাইতেছো। পাইতেছো বলেই শুধু আসি আসি করতেছে।' -'আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।' -'আচ্ছা যাও, তোমার হাতে টাইম ছিল বইলা একটু কথা বললাম। পলিটিক্স করি তো। কথা শুরু করলে থামাতে পারি না।' \হতার পরের পরীক্ষায় দীনা দেখল পাভেল একটা রিকশা ভাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। দীনাকে দেখা মাত্র বলল- 'এটায় ওঠো।' দীনা বলল- 'ভাইয়া, এখন থেকে আপনাকে আর আমার জন্য কষ্ট করতে হবে না। আমি যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে বের হই। হেঁটে গেলেও আমার লেট হবে না।' -'কী যে বলো! কষ্ট কিসের? আমি এই এলাকার ছেলে না? আমি পলিটিক্স করি, আমাকে তো সবাই চেনে। এলাকার মেয়েদের সাহায্যে আমরা এগিয়ে না এলে কে আসবে?' রিকশায় বসে দীনার মুখটা শুকিয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, ভাল ফাঁদেই পড়েছে। এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হবে না। এ কথা বোঝা মাত্র তার হাত-পা যেন অবশ হয়ে যেতে লাগল। তবুও নিজেকে সামলে নিল। ঘাবড়ে গেলে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় সমস্যার সমাধান করতে হবে। সে সিদ্ধান্ত নিল, আগেই কাউকে কিছু বলবে না। টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেলে তার স্কুল থাকবে না। তখন পাভেলের সঙ্গে দেখা হবে না। ক'দিন দেখা না হলে ঝামেলা চুকে যাবে। আর ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গেলে পাভেল আরও রেগে যাবে। পশুদের রাগানো ঠিক না। পশুরা রেগে গেলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে পনেরো দিন। এই পনেরো দিনে সে একবারও বাইরে যায়নি। পাভেলের সঙ্গে দেখা হয়নি। সে নিশ্চয় এতদিনে সরে পড়েছে। বিকালের দিকে দীনা টেস্ট পেপার কিনতে বাইরে বের হলো। ফেরার সময় পাভেল পথ আটকালো। বলল, 'কোথায় গিয়েছিলে?' -'টেস্ট পেপার কিনতে।' -'ও এখন স্কুল নেই তাহলে?' -'টেস্ট পরীক্ষার পর স্কুল থাকে না।' -'এই জন্যই তো দেখি না।' -'আপনি আমাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করেন বুঝি?' -'যা বাব্বাহ! আমি এই এলাকার ছেলে না? এলাকার মেয়েদের সুযোগ-সুবিধা আমরা না দেখলে কে দেখবে?' -'দেখুন, একদিন আপনি আমাকে সাহায্য করেছিলেন, সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তাই বলে এভাবে....?' -'আচ্ছা, আমি কি তোমার সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করেছি?' -'যখন-তখন রাস্তায় একটা মেয়েকে থামিয়ে তার সাথে কথা বলা ভালো ব্যবহারের মধ্যে পড়ে না।' -'যা বাব্বাহ! এলাকার মেয়েদের সঙ্গে কথা-বার্তাও বলা যাবে না দেখছি।' -'কথা বলা যাবে না তা নয়। প্রয়োজনে অবশ্যই বলা যাবে। আপনি অপ্রয়োজনে যখন-তখন আমার সঙ্গে কথা বলতে আসছেন।' -'আচ্ছা সরি বলছি। আর শোন, প্রতিদিন বিকালে যে লোকটা তোমাদের বাসায় ঢোকে সে কে?' -'আপনি কি রায়হান স্যারের কথা বলছেন? উনি আমার টিচার। আমাকে পড়ান।' -'প্রতিদিন পড়ান! এ কেমন টিচার? আমি তো জানি টিচাররা সপ্তাহে তিন দিনের বেশি পড়ান না। তিন দিনের কথা বলেও গ্যাপ করেন। আর.....।' -'আমি তার কাছে ক্যামিস্ট্রি, ফিজিক্স, ম্যাথ ও ইংরেজি পড়ি। তাই তাকে প্রতিদিন আসতে হয়। এ জন্য আমরা বেতনও বেশি দেই। অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে পড়তে গেলে সময় নষ্ট হয় তাই.....।' -'এক টিচার সব কিছু পারে? এ দখছি আইনস্টাইনের বাপ!' -'তিনি খুবই ব্রিলিয়ান্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স-এ পড়েন। ক্লাশ টেন-এর কেমিস্ট্রি, ম্যাথ, ইংলিশ এমন কিছু নয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তুখোর ছাত্র তা পারবেন না।' -'আচ্ছা, বুঝেছি-বুঝেছি।' -'কী বুঝেছেন আপনি? তিনি যদি ভালো না পড়াতেন আমি প্রতি ক্লাশে ফার্স্ট হতে পারতাম না। আমি যখন ক্লাশ সেভেন-এ তখন থেকে তিনি আমাকে পড়ান। তখন থেকে আমি প্রতি ক্লাশে ফার্স্ট।' -'থাক, আর প্রশংসা করতে হবে না।' পরদিন রায়হান যখন পড়াতে এলো, তখন তাকে খুব বিপর্যস্ত লাগছিল। মুখটা ভীষণ ফ্যাকাশে। ঠিকমতো কথাও বলতে পারছিল না। ঘামছিল খুব। নিঃশ্বাস ফেলছিল দ্রম্নত। দীনা বলল, 'স্যার পানি খাবেন?' -'দাও এক গস্নাস।' -'ঠান্ডা পানি দেব?' -'দাও।' রায়হান এক চুমুকে গস্নাস নিঃশেষ করল। তারপরও শান্ত হতে পারছিল না। দীনা বলল, 'স্যার, আপনি কি অসুস্থ?' -'না ঠিক আছি।' -'স্যার, আপনাকে ঠিক মনে হচ্ছে না।' -'মানে হঠাৎ একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।' -'কী সমস্যা স্যার?' -'বোধ হয় আমার পক্ষে তোমাকে আর পড়ানো সম্ভব হবে না।' -'কেন স্যার? কোনো চাকরি হয়েছে?' -'না না, তা নয়। মাস্টার্স শেষ হলো না চাকরি হবে কেমন করে? আসলে ব্যাপারটা অন্যরকম।' -'কী অন্যরকম?' -'আজ আসার সময় মোড়ে এক ছেলে আমার পথ আগলে আমার বুকে........। আরেক গস্নাস পানি দাও।' দীনা পানি এনে দিল না। বলল, 'স্যার, শুধু পানি খেলে কি সমস্যার সমাধান মিলবে?' -'কী করতে পারি?'
-‘আমার পরীক্ষার আর মাত্র দুই মাস বাকি। এ সময় আপনাকে ছেড়ে দিলে আমার সমস্যা হবে। বলছিলাম কি, পুলিশকে জানাই।’
-‘তোমার কি মনে হয় ব্যাপারটা পুলিশকে জানালে বিশেষ লাভ হবে?’
-‘বর্তমানে ইভ টিজিং নিয়ে সারাদেশে খুব তোলপাড় হচ্ছে। সরকার নতুন আইন করেছে। পুলিশও দ্রæত ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
-‘পুলিশ যদি জরুরি কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে বিপদ কিন্তু আরও বেড়ে যাবে।’
-‘আমার মনে হয় নেবে। আমি বাবাকে ব্যাপারটা জানাতে চাচ্ছি না। শেষে আবার অন্যরকম সমস্যা.....। তাহলে কাল সকালে আপনি আসুন। আমি আপনাকে নিয়ে থানায় যাব। আমি নিজে পুলিশকে সব খুলে বলব। একটা মেয়ের কথা শুনলে তারা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।’
সকাল সাড়ে ৯টা। থানার বড়কর্তা মাত্রই অফিসে এসেছে। অফিসে তার প্রথম কাজ হলো এক কাপ চা খাওয়া। তারপর আয়েশ করে একটা সিগারেট টানা। তারপর পত্রিকায় চোখ দেয়া। চা আসার আগেই দীনা আর রায়হান তার রুমে ঢুকল। স্বাভাবিকভাবেই তার রুটিনে ওলট-পালট এসে গেল। সে বিরক্ত হলো। বিরক্ত হলো আরও যে, তারা আগে খবর না দিয়ে সরাসরি রুমে ঢুকে পড়েছে। সে বিরক্তি চাপা রেখে বলল, ‘বসুন। কিছু বলবেন?’ দীনা বলল, ‘আমার এলাকার এক বখাটে আমাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে। আমি পথে নামলেই সে আমার পথ আগলে দাঁড়ায়। আজেবাজে কথা বলে।’
-‘তোমার এলাকার নাম?’
দীনা তার নিজের এলাকার পরিচয় দিল। পাভেল যে ক্লাবঘরে বসে থাকে সেটার কথাও বলল। বড়কর্তা পাভেলকে চিনতে পারল। মাথা দুলিয়ে বলল, ‘তাকে আমরা চিনি। তার নামে আমাদের কাছে আরও অভিযোগ আছে। কিন্তু তার ব্যাপারে আমাদেরও একটু সমস্যা আছে।’ রায়হান বলল, ‘আপনাদের কী সমস্যা?’
-‘সে স্থানীয় এমপি’র বডিগার্ড।’
-‘তাই বলে আপনারা অন্যায়ের প্রতিকার করবেন না?’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে, আপনাদের সমস্যাটা বিস্তারিত বলুন।’
দীনা প্রথম থেকে প্রতিদিনের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বলল। আরও বললÑ ‘এখন আরও ঝামেলা করছে। ইনি আমার টিচার। আমি যখন ক্লাশ সেভেনে তখন থেকে তিনি আমাকে পড়ান। কাল তার বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে বলেছে, তিনি যেন আমাকে আর পড়াতে না আসেন। সামনে আমার এসএসসি পরীক্ষা এখন........।’
-‘হঠাৎ সে তারর ওপর চটে গেল কেন?’
-‘তা আমরা কী করে বলব?’
-‘কিছু মনে করো না.....তোমাদের মধ্যে সেরকম কোনো......।’
-‘মি. ইনসপেক্টর, আপনার আর পাভেলের মধ্যে আমি বিশেষ তফাত খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। আর যদি কোনো সম্পর্ক থাকেও এ ঘটনার সঙ্গে সেটার কোনো সম্পর্ক থাকার কথা না।’
রায়হান কখনো প্রতিবাদী হতে পারে না। অনেক অন্যায়ই সে হজম করে নেয় প্রতিবাদহীন। তবে এ ক্ষেত্রে সেও চুপ থাকতে পারল না। বলল, ‘একটা স্কুল পড়–য়া ছোট মেয়ে নিরুপায় হয়ে আপনার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছে। যার বিরুদ্ধে সে অভিযোগ নিয়ে এসেছে সে যে একটা বখাটে তা আপনিও জানেন। অথচ আপনি মেয়েটাকে সাহায্যের আশ্বাস না দিয়ে বলছেন, অন্যরকম কথা। সহজ কথায় বাজে কথা বলছেন। ইউ আর টর্চারিং হার মেন্টালি। আই থিংক, ইউ আর অলসো অ্যান ইভ টিজার।’
-‘আপনি অযথাই রেগে যাচ্ছেন। আসলে আমি সেভাবে......যাকগে, আপনারা অভিযোগ লিখে যান। আমি ব্যবস্থা নেব। আর মেয়ে তুমি শোন, তোমার যে মাথা গরম স্বভাব তা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি তোমার বাবার বয়সি। তার ওপর আইনের লোক। তুমি আমাকে একটা সন্ত্রাসীর সঙ্গে তুলনা করছ।’
-‘বাবার বয়সি হয়ে মেয়ের অসহায়ত্ব না বুঝে এলোমেলো বকলে.......।’
ফেরার পথে রিকশায় বসে রায়হান বললÑ ‘পুলিশের কাছে যাওয়াটা ভুল হয়ে গেছে। মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে।’ দীনা কিছু বললো না। চিন্তায় তার কপাল কুঁচকানো।
কিছুদূর গিয়ে রায়হান নেমে গেল। তার অন্য কোথাও কাজ আছে। দীনা রিকশা নিয়ে এলাকায় প্রবেশ করতেই পাভেল তার রিকশা থামাল। বলল, ‘টিচারকে নিয়ে তাহলে আজকাল বেড়াতেও বের হচ্ছো।’
-‘বেড়াতে যাইনি, আমরা একটা কাজে গিয়েছিলাম।’
-‘ও তাই বল। কী বলব, তোমাকে। আমি তো এই এলাকারই ছেলে। পলিটিক্স করি, তাই সবাই আমাকে চেনে। কথা হলোÑ প্রথম দেখায়ই তোমাকে আমার ভালো........। সেদিন যে তুমি হেসে উঠেছিলে। তোমার সেই হাসিটা হৃদয়ে......!’
-‘দেখুন, সামনে আমার পরীক্ষা। আপনার কারণে আমার লেখাপড়ায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে।’
-‘যা বাব্বাহ! আমি আবার কী করলাম? আমি কি পড়ার সময় তোমার বইপত্র কেড়ে নেই? এ এলাকার সবাই আমাকে চেনে।’
-‘চিনলেও ভালো লোক হিসেবে চেন না। চেনে.....।’
-‘থামো! তোমাকে আমি ভালোবাসিÑ আই লাভ ইউ সো মাচ, সো তোমার সব কথাই আমি হজম করে নেব। ভালোবাসার জন্য সবাই কিছু না কিছু হজম করে। তবে...তবে তুমি অন্যের সঙ্গে ফস্টি-নস্টি করবে সেটা হজম করব না। তোমার ওই টিচার যেন আর না আসে।’
-‘আর আসবে না মানে? আমার পরীক্ষা পর্যন্ত তাকে আসতেই হবে।’
-‘দেশে টিচারের কি অভাব পড়েছে?’
-‘টিচারের অভাব না থাকলেও ভালো টিচারের অভাব আছে। আর দুই মাসের জন্য একজন টিচার পাওয়া কঠিন।’
-‘আচ্ছা, তোমার ফোন নাম্বারটা দাও তো।’
-‘আমার কোনো ফোন নাম্বার নেই। আমি ফোন ব্যবহার করি না।’
-‘ফোন নাম্বার নেই? ফোন ব্যবহার করো না? আশ্চার্য! এ যুগের মেয়ে হয়ে......। তাহলে বাসার নাম্বারটা দাও।’
-‘বাসার নাম্বার আমি কাউকে দেই না।’
-‘যা বাব্বাহ! আমি এই এলাকার ছেলে না? সবাই আমাকে চেনে।’
-‘রিকশাওয়ালা ভাই যানতো।’
ক্লাবের সামনে পাভেল রায়হানের রিকশা থামালো। বলল, ‘¯øামালিকুম স্যার। আমার নাম পাভেল। আমি এই এলাকারই ছেলে। আমি পলিটিক্স করি, আমাকে সবাই চেনে।’
-‘সেদিনও আপনার পরিচয় দিয়েছিলেন।’
-‘দিয়েছিলাম? পলিটিক্স করি তো, মাথায় অনেক চিন্তা। সবকিছু মনে থাকে না।’
-‘ধন্যবাদ।’
-‘ধন্যবাদ দিয়ে চলে যাবেন তা হবে না। আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। রিকশা ভাড়া কত? আমি দিয়ে দিচ্ছি।’
-‘না না, আপনি আমার রিকশা ভাড়া দেবেন কেন?’
-‘আপনি শিক্ষক মানুষ। শিক্ষকরা হলো মানুষ গড়ার কারিগর-সমাজের বিবেক। এ টিচার ইজ দ্য ক্রিয়েটর অব দ্য নেশন। আপনার ভাড়া দিতে পারা তো আমার জন্য সৌভাগ্য।’
পাভেল রায়হানকে হাত ধরে ক্লাব ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। চায়ের অর্ডার দিল। তারপর বলল, ‘আপনি শিক্ষিত লোক। শিক্ষিত লোক কি এমন ভোদাই হয়?’
-‘আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
-‘আমার নামে থানায় নালিশ করতে গেলেন কেন বলুনতো? নালিশ করেছেন তাও তো সাত দিন হয়ে গেল। পুলিশ কি আমার একটা বাল ছিঁড়েছে? এই এখন আপনাকে আমি স্যুট করব। কাল দেখা যাবে পুলিশের কী ডাইলগ! অপরাধী যেই হোক না কেন পাড় পাবে না। ধরা তাকে পড়তেই হবে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ধরে ফেলবো ইত্যাদি-ইত্যাদি-ইত্যাদি। ভাইরে, মানি অ্যান্ড পাওয়ার.....আপনি ব্যাপারটা বোঝেন না? আমি পলিটিক্স করি। আমি এমপি’র লোক।’
দীনা দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়। অবশেষে সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আজ রায়হান এলেই সে তাকে মানা করে দেবে। কী দরকার নিজের স্বার্থের কথা ভেবে তাকে বিপদে ফেলা? তার পরীক্ষার প্রস্তুতি মন্দ নয়। এ কয়দিন একা একা পড়লেও রেজাল্ট খারাপ হবে না।
এমন সময় তারই ক্লাসের ছেলে নেহাল (পাশের বাড়িতে থাকে) দৌড়ে এসে বলল-‘দীনা দীনা, তোমাকে যে টিচারটা পড়াতে আসতেন পাভেল ভাই তাকে গুলি করেছে।’
পুলিশের সেই বড়কর্তা এসেছে তার দলবল নিয়ে। এসেছে অনেক সাংবাদিক। পাড়ার লোকজন ভিড় করেছে। উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বড়কর্তা বলল-‘চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমরা অপরাধীকে ধরে ফেলব। কিছুতেই......।’
দীনা স্তব্ধ।
বড়কর্তা দীনার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় হাত রেখে বললÑ ‘মা তুমি বলো কেন ও কীভাবে...........?’
দীনা এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিল। মুখ থেকে এক দলা থুথু বের করে ছুড়ে দিল বড়কর্তার মুখে। উপস্থিত সবাই হতবাক।
বড়কর্তা কিছু সময় নির্বিকার থেকে উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললÑ ‘সবার আগে আমাকে অ্যারেস্ট করা হোক। আমিই প্রধান অপরাধী। সত্যি বলছি, আমিই মূল অপরাধী।’
উপস্থিত জনতা পরস্পরের মুখে তাকাতে লাগল। পুলিশ কেন এরকম কথা বলছে?