চলিস্নশ দশকের বিদ্রোহী ও কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৫ আগস্ট, ১৯২৬ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যা তখন ব্রিটিশ ভারতের একটি অংশ ছিল। তার পিতা নিবারণ চন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন একজন প্রকাশক এবং একটি লাইব্রেরির মালিক; সেই সুবাদে সুকান্তের বিশ্বদৃষ্টি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
\হকৈশোর থেকেই তিনি সাম্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সুকান্ত ছোটবেলা থেকেই বিস্তৃত ধারণা ও দর্শনের সঙ্গে পরিচিত। লেখালেখি ও কবিতার প্রতি সুকান্তের আবেগ প্রথম দিকেই বিকশিত হয় এবং শিগগিরই তিনি নিজেকে একজন প্রতিভাবান ও প্রসিদ্ধ লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার কবিতা সাহসী এবং বিপস্নবী চেতনার অধিকারী। সুকান্তের বিপস্নবী লেখা তাকে ব্যাপক পরিচিতি ও প্রশংসিত করেছিল। তার কবিতা শ্রেণি, ধর্ম, জাতিগত বাধা অতিক্রম করে সর্বস্তরের মানুষের কাছে অনুরণিত হয়েছিল।
বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী কবি। চলিস্নশের বিশ্ব যুদ্ধের তান্ডব ও মরণ ছোবলের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন কবি সুকান্ত। দেশ বিভাগের সহিংসতা এবং রক্তপাত প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা নিপীড়িত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারের জন্য লড়াই করেন।
যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষে ঝাঁঝরা হলেও মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থেকে ছিল বাংলাদেশ। দুর্ভিক্ষে লাশ হওয়া মানুষের কঙ্কালের উপর দিয়ে চলল ব্রিটিশের যুদ্ধের অভিযান। মৃতু্য মানুষের হার গুঁড়িয়ে চললো ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া আজানের বহর। সেই বিচূর্ণ হারের ভেতর থেকে জ্বলতে থাকল আগুন। জ্বলে উঠলো প্রতিরোধের দাবানল। কোটি শিখা হয়ে দিকে দিকে জ্বললো স্বাধীনতার মশাল। সেদিনের সেই নবজাগ্রত বাংলাদেশকে বিপস্নবী কবি সুকান্ত দেখেছেন তার তিমির বিদারী উদার অভু্যদয়ের এক রক্তিম সূর্যালোক। 'দুর্মর' শিরোনামের কবিতায় এই জাগরণকে নন্দিত করে তিনি লিখলেন:
'হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ
কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে;
সেই কোলাহলে রুদ্ধ রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ্য
জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।'
এর পরের স্তবকে লিখেলেন:
'হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন
জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান;
গত আকালের মৃতু্যকে মুছে-
আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ'
শেষে রক্তের হরফে আগাম বিজয়ের ঘোষণা রাখলেন বিপস্নবী তরুণ এই কবি:
'শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী তাকিয়ে রয়:
জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়
এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে সোনালি নয়তো রক্তে রঙিন ধান,
দেখবে সবাই সেখানে জ্বলছে দাউ দাউ করে বাংলাদেশের প্রাণ।'
মহৎ কবিরা আগামী দিনকে ধারণ করে তাদের অনুভবে। চলিস্নশ দশকের শেষ দিকে কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ভবিতব্যের মতো।
দুই দশক পরে সত্তরে এসে জ্বলে পুড়ে ছারখার হওয়া বাংলাদেশের মাঠ থেকে আমরা তুলেছি স্বাধীনতার ফসল। আর সেই ফসল ছিল রক্তধোঁয়া।
কারণ, ত্রিশ লাখ শহীদের খুন রাঙা ছিল আমাদের মাঠের সেই ধান।
তার কবিতাগুলো স্বাধীনতার জন্য একটি মিছিলকারী আর্তনাদ ও জনসাধারণের মধ্যে প্রতিরোধের চেতনা জাগিয়ে তোলে।
দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো বাংলাদেশের প্রাণ
কেন ঘরে ঘরে গড়ে উঠলো এত রণাঙ্গন?
কেন এত রক্ত বিসর্জন?
সুকান্ত এই প্রশ্নের উত্তর লিখেছিলেন:
\হ'এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান
চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ'
প্রাণপণে পৃথিবীর সারাবো জঞ্জাল অঙ্গীকার ঘোষণা করে বলেন:
এ বিশ্বকে,
এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি;
নব জাতকের কাছে আমার দৃঢ অঙ্গীকার করে লেখেন:
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুরে- করে যাবো আশীর্বাদ
'তারপর হবো ইতিহাস'।
কি আশ্চর্য মিল সুকান্তর এই পঙ্গক্তিগুলোর সঙ্গে সত্তর দশকের যুদ্ধের সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণে আগামী দিনের শিশুদের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ রচনার প্রত্যয় জাগিয়ে তুলেছেন এই নতুন প্রজন্মের কবি।
উচ্চকিত সরে গাইছেন:
\হ'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি;
মোরা একটি শিশুর মুখে হাসি ফোটাবো বলে যুদ্ধ করি'
১৯৭১ সালে, যখন বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে সুকান্তের লেখাগুলো ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়। তার বাণী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং বাঙালির সম্মিলিত চেতনা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কালজয়ী কবিতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি অটল অঙ্গীকারের মাধ্যমে বেঁচে থাকে। তার কবিতাগুলে সামাজিক পরিবর্তন আনতে শিল্প ও সাহিত্যের শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।