ভাবনায় চেতনায় বই

প্রকাশ | ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

কামরুল হাসান
বই কোনো মৃতবস্তু নয়, এটি মানবসভ্যতার এক অতুলনীয় সৃষ্টি। একটি ভালো বই হলো এক মহান আত্মার জীবনরক্ত। একটি বই শুধু বস্তু নয়, এটি মানুষের চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতার অবিচ্ছেদ্য প্রতীক। তাই যে বই পড়া হয় না, সেটি বই নয়, একটি হালকা বা ভারী বস্তু মাত্র। বই তখনই বই হয়ে ওঠে যখন তা পড়া হয় এবং পড়ার মাধ্যমে বইয়ে প্রাণ সঞ্চারিত হয়; এবং বই সত্যিকার অর্থে বই হয়ে ওঠে। বই পড়া পড়ার অভ্যাসই মানবজাতির সবচেয়ে দামি সম্পদ। এটি মানুষের জ্ঞান ও শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে, আনন্দ দান করে এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে। এটি ব্যক্তিকে আত্মবিশ্বাসী ও দক্ষ করে তোলে। একই সঙ্গে এটি মানুষের স্বভাবের উৎকর্ষতা সাধন করে এবং মানুষকে পূর্ণতা দান করে। নবজাগরণের সাথী বই পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ায় ঘটে যাওয়া রেনেসাঁ ইউরোপীয় ইতিহাসে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে পদার্পণের গুরুত্বপূর্ণ সময়। রেনেসাঁসের মাধ্যমেই পৃথিবীতে নতুন সূর্য উদিত হয় (আধুনিক যুগের সূচনা ঘটে)। চারশ' বছর ক্রুসেডের যুদ্ধের পর এশিয়া থেকে ইউরোপ- বিশেষ করে ইতালিতে ক্লাসিক্যাল পুঁথিপত্র ঠাঁই করে নেয়। ক্লাসিক্যাল এসব গ্রন্থের নবাবিষ্কৃতিই পনেরো ও ষোলো শতকে ইউরোপে রেনেসাঁর জন্ম দেয়। এ সময়টাতে ইউরোপীয়রা প্রচুর বই পড়ায় নিমগ্ন ছিলেন। তবে তারা এমন বোধ করতেন না যে তারা জ্ঞানানুসন্ধান করছেন। তারা গ্রিকদের ভক্তি করতেন তাই তারা গ্রিকদের রচনা পাঠ করে তাদের অনুকরণ করতেন। রেনেসাঁসের সময় বই পড়া ছিল জীবনের আনন্দের অংশ- সুরা পান ও যৌনকর্মের মতো। এটা শুধু সাহিত্যের বেলায় সত্য- এমন নয় অন্যান্য জটিল বিষয়ের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। বই ও দৃষ্টিভঙ্গি আমরা প্রায়ই দেখি, আমাদের মধ্যে অনেকেই কেতাবি মনোভাব পোষণ করেন, বইয়ের সবকিছুকেই স্বতঃসিদ্ধ মনে করেন। এমন মনোভাব পোষণ করা ঠিক নয়। কারণ আমরা যদি স্মরণ করি তাহলে দেখব 'ক্যাদিদ'-এ ভোলতেয়ার কী ধরনের মতামতকে আক্রমণ করেন। এবং 'ডন কুইকজট' উপন্যাসে সার্ভেন্টিস বাস্তবতার প্রতি কোন ধরনের মতামতকে ব্যাঙ্গ করেন। অতএব পড়ার সময় আমাদের অন্তচক্ষু ও চর্ম চক্ষু দুই খোলা রাখতে হতে হবে। বই ও কালক্ষেপণ পড়ার সময় নিয়ে আমাদের দুটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে, প্রথমটি হচ্ছে- অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে- অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা। প্রথমটা সর্বসাধারণের বেলায় প্রযোজ্য। কারণ অনাদিকাল ধরে জীবন দুটি পরিপূরক অংশে বিভক্ত, প্রথম অংশটি, শিক্ষা গ্রহণের সময়, দ্বিতীয়টি কাজের সময়। পড়ায় মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় করা মানে অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবহেলা করা। কারণ প্রাত্যহিক জীবনে পড়া বাদে ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। দ্বিতীয়টি পড়ার মাধ্যমে যারা প্রভাব তৈরি করতে চায়, নিজেদের ছাপ রাখতে চায় তাদের জন্য প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে ইবনে রুশদের নাম উলেস্নখ করা যেতে পারে। তার অধ্যয়নের নেশা এতই প্রবল ছিল যে, সত্তর বছর বয়সেও তিনি ষোলো-ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন এবং তিনি প্রভাব তৈরি করতেও সক্ষম হন। একাদশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় সিলভেস্টার পোপকে জাদুকর মনে করা হতো শুধু এ কারণে, তিনি অনেক বইপত্র পড়েছিলেন। দুহাজার বছর বয়সি এক বৃদ্ধ ও তার প্রভাব বই যুগের সীমানা অতিক্রম করেও কীভাবে যুগ যুগ ধরে প্রভাব বিস্তার করা যায় এ বিষয়ে আমি যদি ইতিহাস থেকে উদাহরণ অবতরণ করি তাহলে কেউ যেন আশ্চার্যান্বিত না হয়! এক্ষেত্রে আমি শুধু মাত্র ১টি বইয়ের কথাই উলেস্নখ করব, সেটি হচ্ছে পস্নম্নটার্ক রচিত 'প্যারালাল লিভিং'। প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি সময়ে লেখা এ বইটির দুহাজার বছরের জীবনচক্র যদি একটু লক্ষ করি তাহলে আমরা একটি বিষয় অনুধাবন করতে সমর্থ হব, বই যুগের সীমানা অতিক্রম করে কীভাবে ব্যক্তির ও জাতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। বৃদ্ধের ইতালি পাঠ ইতালির ফ্লোরেন্সে পস্নম্নটার্কের জীবনীমালা প্রথম ছাপা হয় ১৫১৭ সালে। শুরু হয় পস্নম্নটার্ক জীবনীমালা চর্চা। জীবনীমালার চরিত্রগুলোর বীরোচিত মহিমা ও মানবিক আদর্শ পনেরো ও ষোলো শতকের ইউরোপীয়দের চিন্তার নায়ক হয়ে ওঠে। ক্লাসিকাল এসব গ্রন্থের নবাবিষ্কৃতিই ইউরোপে রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে। অতএব পস্নম্নটার্ককে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের অন্যতম উদ্দীপক বলা যেতে পারে! বৃদ্ধের ফ্রান্স পাঠ ফরাসি ভাষায় পস্নম্নটার্ক জীবনীমালা অনূদিত হয় ষোলো শতকে। ফরাসি সাহিত্যিক রেবলে (১৪৯৪-১৫৫৩) পস্নম্নটার্কের 'জীবনীমালার' কথা উলেস্নখ করেন। এ ছাড়া পস্নম্নটার্কের বিশেষ প্রভাব লক্ষ করা যায় ফরাসি রেনেসাঁর অন্যতম বিখ্যাত দার্শনিক ও প্রাবন্ধিক মিশেল ডি মন্টেই (১৫৩৩-৯২)-এর মধ্যে। মঁন্টেইন পস্নম্নটার্ক পাঠ করেছিলেন জ্যাক আমিয়ো (ঔধপয়ঁবং অসুড়ঃ), কর্তৃক অনুবাদের মাধ্যমে। মন্টেইন প্রবন্ধ বা বংংধু-কে একটি স্বতন্ত্র সাহিত্যিক শৈলী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রসারিত করেছিলেন, মিশেল দে মঁন্টেইন তার রচনায় গ্রিক দার্শনিক পস্নম্নটার্কের প্রভাবকে ব্যাপকভাবে স্বীকার করেছেন। মঁন্টেইন তার "ঊংংধরং"-এ প্রায়শই পস্নম্নটার্কের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন, যা তার রচনার একটি উলেস্নখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। পস্নম্নটার্কের মানবিক গুণাবলি ও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ মঁন্টেইনের চিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছে। বৃদ্ধের ইংল্যান্ড পাঠ ষোলো শতকেই জীবনীমালা ইংরেজিতে অনুবাদ হয় স্যার থমাস নর্থ কর্তৃক। নর্থের অনুবাদ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৫৭৯ সালে। নর্থকৃত জীবনীমালার অনুবাদ শেক্সপিয়ারকে তার কমেডি নাটকের উপাদান সংগ্রহে ও ট্র্যাজেডির নায়ক সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়েছেল। শেক্সপিয়ারের নাটকে নর্থের অনুবাদের বহু উদ্ধৃতি লক্ষ করা যায়। রুশোর বৃদ্ধের জীবনীমালা পাঠ আঠারো শতকে সুবোধ বালক ও পরবর্তীতে ফরাসি বিপস্নবের মহাবীরখ্যাত 'রুশোর' পস্নম্নটার্ক পাঠ! রুশোর লেখা সোসাল কনট্রাক্টই ফরাসি বিপস্নবের শক্তি জুগিয়েছিল। রুশো যখন পস্নম্নটার্ক পাঠ করেন তখন তার বয়স ১০-১৩ এর কোটায়! লক্ষ করুন রুশোর ওপর জীবনীমালার প্রভাব। রুশো তার কনফেশনে উলেস্নখ করেন 'বাবা যখন কাজ করতেন আমি তখন তাকে শুনিয়ে এই বইয়ের রাজ্য থেকে এ বই সে বই পাঠ করে শোনাতাম। এর মধ্যে পস্নম্নটার্কের প্রতি আমার একটা বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি হলো। পস্নম্নটার্ক থেকে পাঠের পর পাঠ আমাকে যেন আমার এতদিনের স্বপ্নের জগৎ থেকে বাস্তব জগতে বের করে আনল। এর ফলে আমার জীবনের নায়ক হয়ে উঠতে লাগল এগোসিয়াস, ব্রম্নটাস, অ্যারিসটাইডিস, অরনডেটিস, আরটামেলিস আর জুবা। এরাই হয়ে উঠল আমার আরাধ্য এ এক আশ্চর্য কাহিনী! বৃদ্ধের জার্মান পাঠ জার্মানিতে পস্নম্নটার্ক অনূদিত হয় আঠারো শতকের শেষে। মহাকবি গ্যাটে ও শিলার পস্নম্নটার্ক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এমনকি সুরস্রষ্টা বেতোফেন ও দার্শনিক নিটশে পস্নম্নটার্ক অধ্যয়ন করছেন। উনিশের ফ্রান্সে আবার ও বৃদ্ধি উনিশ শতকের ফ্রান্সে আবারও অ্যামিয়ো অনূদিত 'পস্নম্নটার্কের জীবনীমালা' ব্যাপক পাঠিত হয়েছে। ফরাসি বিপস্নবের হোতারা জীবনীমালার নায়কদের বীরোচিত আদর্শ ও মহিমাবোধ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফরাসি বিপস্নবের অন্যতম কারিগর জা পল সার্ত শেষ বিদায়ের আগের দিন ও পস্নম্নটার্কে নিমগ্ন ছিলেন। বৃদ্ধের আমেরিকা ভ্রমণ উনিশ শতকে? আমেরিকাতে পস্নম্নটার্কের জীবনীমালা বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে দার্শনিক এমারসনকে। বৃদ্ধের বাংলাদেশ অভিজ্ঞতা বৃদ্ধকে চেনা এক যুবক পাগলের মতোই বইমেলা খুঁজে বের করল বৃদ্ধের রচিত জীবনীমালা! বই হাতে নিতেই স্টলের দায়িত্বরত ভদ্রমহোদয়গণ মহা উলস্নাসে ফেটে পড়ল। (কে ভাই তুই আমাদের আপদ দূর করতে এসেছিস!) যাহোক, যুবকটি বৃদ্ধের জীবনীমালাসহ আরও কিছু প্রবীণ ন্যাট্যকারদের লেখা নাটকের খোঁজ করল, দাম দর করতে গিয়ে স্টল থেকে একজন তো অট্টহাসি হেসে বলল, ভাইয়া আপনি যদি এসব বই নেন তাহলে আমরা বাঁচি। আপনাকে ডিসকাউন্ট দেব এই বইগুলো কেউ কেনে না! বলে আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বড় লজ্জিত হয়েই যুবককে সেদিন এগুলো সংগ্রহ করতে হয়েছিল! বৃদ্ধের প্রতি মনোভাবজনিত পার্থক্য এবার একটু ভালো করে লক্ষ করুন ইউরোপীয়দের সঙ্গে আমাদের পার্থক্যটা কোথায়! বৃদ্ধের প্রতি আমাদের এমন মনোভাবই আমাদের ব্রিটিশ, জার্মান, ফ্রান্স, আমেরিকা থেকে এভাবে পৃথক করে রেখেছে এবং তাদের শিকলে আবদ্ধ রেখেছে! প্রতিকার অদ্ভুত মনে হলো হলেও একথা সত্য, বৃদ্ধের নিবিড় পাঠ ব্যতীত আমাদের মধ্যে বড় পরিবর্তন সম্ভব নয়, শুধু এই বৃদ্ধ একা নয় এমন কিছু প্রবীণ ও নবীন বৃদ্ধের সঙ্গে এ জাতির তরুণ-তরুণীদের নিবিড় সংযোগ স্থাপন ব্যতীত জাতি হিসেবে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই '২৪-এর বাংলাদেশে এই বৃদ্ধ ও আরও কিছু বোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে চাই। পরিশেষে এ কথাই বলব- পরিবর্তন আমাদের চাই-ই চাই! পরিবর্তনই পরিবর্তনের সূচনা করে। এজন্য বৃদ্ধ, বোদ্ধা ও বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। তাই প্রত্যেকটি যুবকের এ অবস্থায় এই বৃদ্ধদের স্বাগত জানানো উচিত। দেশের স্বার্থে নিজের স্বার্থে বইয়ের সঙ্গে একটু ওঠা-বসা করা উচিত। এটি মানবজাতির প্রত্যেকের জন্য একান্ত জরুরি, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা তরুণ-তরুণীর জন্য একান্ত জরুরি।