অলকানন্দা

প্রকাশ | ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

আবু হেনা মোস্তফা কামাল
হেমন্তের সন্ধ্যা। সূর্য তখনো অস্ত যায়নি, বিকেলের আলো মস্নান হয়ে আসছে। শহরের গলিগুলো রোজকার মতোই ব্যস্ত, আর কফিশপের কোণায় রেহেনুমা চুপচাপ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে আছে। চায়ের বাষ্প তার চোখে জমানো অতীতের কুয়াশাকে আরও ঘন করে তুলছে। ষোল বছর আগের এক বিকেল যেন আজও অমলিন। আদিব- এই নামটা বারবার ফিরে আসে তার স্মৃতির দরজার চৌকাঠে। ষোল বছর আগের শেষ দেখা ও কথা- মনের কোণের গোপন গহ্বরে কোনো এক সিন্ধুকে আটকে আছে যেন। সেই বিচ্ছেদের বিকেলে রেহেনুমা এমন কী বলেছিল? নাকি নীরবতা ছিল তার বিরহী উত্তর? আদিব কেনই-বা চলে গিয়েছিল? উত্তরগুলো গোধূলির আলোর মতো আজও অস্পষ্ট, কিন্তু সেই নিঃশব্দতা আজও চায়ের কাপে বাষ্প হয়ে বারবার ফিরে আসছে। একই সময়ে, আদিব কবিতার বই হাতে নিজের ঘরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। এলোমেলো গোছের ঘর, বুক শেলফ, একটা ছোট টেবিল আর এক কোণে একটি ভাঙা চেয়ার। মনের ভেতর হঠাৎ হঠাৎ অস্থিরতা কাজ করে চলেছে। মেসেঞ্জারে রেহেনুমার লাস্ট ম্যাসেজটা হুট করেই মগজের স্মৃতিতে তাজা হয়ে উঠল। 'আদিব!' মনে পড়ে গেল অতীতের দিনগুলোর কথা, সারাদিন সাপের মতো আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে এলোমেলো হেঁটে চলা, কথার পিঠে কথা সাজিয়ে অহেতুক গল্পের নদীতে নদীতে ডুবে থাকা- এভাবেই বিকেল গড়িয়ে গোধূলির হাত ধরে সন্ধ্যা হয়ে যেত নিমেষে, নিয়মিত, প্রতিদিন। এমন গভীর ভালোবাসা, মনের রিনিঝিনি অভিব্যক্তি আর সরলতার আড়ালেও ছিল কিছু অব্যক্ত চাপা কষ্ট, যা শেষমেশ তাদের আলাদা করতে বাধ্য করেছিল। তারপর গড়িয়ে গেছে অনেক সময়। সময়ের প্রয়োজন তাদের চলার পথকে করেছে আলাদা আলাদা। জীবন গিয়ে মিশেছে নিজ নিজ কর্ম ব্যস্ততায়, সংসারে, সমাজে। তবু পুরোনো অনুভূতিগুলো হঠাৎ করে কেন আজ তার মগজের চিন্তায় জীবন্ত হয়ে ফিরে এলো? 'নীলফামারী সাহিত্য আসর' নীলফামারীতে বসবাসরত লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের নিয়ে তৈরি হওয়া ফেসবুকের একটি জনপ্রিয় পেজ। এখানে অনেকেই নিজেদের লেখা পোস্ট করে, শেয়ার করে। দুই সপ্তাহ আগে ওই পেজে আদিব তার লেখা পুরনো একটি কবিতার চার লাইন পোস্ট করেছিল- 'কিছু বিকেল জমানো থাকে,/গোধূলির রঙের মতো।/কিছু ব্যথা, চিরকাল/বুক পেতে নিতে হয়।' কাকতালীয়ভাবে রেহেনুমার চোখ আটকে গিয়েছিল সেই কবিতায়। প্রতিটি শব্দই তার হৃদয়ের গভীরে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দিয়ে গেল। এটা তো আদিবের লেখা! তার কবিতার স্টাইল তো ঠিক এই রকমই- নির্মল, সাবলীল গল্প বলার মতো করে কবিতার পরিধি এগিয়ে গিয়ে হুট করে শেষে এসে থমকে যেত, অথচ কী গভীর অনুভূতির ব্যঞ্জনায় ভরে থাকত প্রতিটি শব্দ। রেহেনুমা ম্যাসেঞ্জারে লিখল, "তুমি এখনো লেখ?" উত্তর এলো 'হঁ্যা, মাঝে মাঝে। কেমন আছ?' এরপর অল্প অল্প করে মেসেজের কথা বাড়তে থাকল। পুরনো স্মৃতির রোমন্থন, বর্তমান জীবনের গল্প। কথার ফাঁকে একদিন রেহেনুমা জানতে চাইল, 'আমরা কি একদিন দেখা করতে পারি?' কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে থাকল আদিব। দেখা করার ইচ্ছে থাকলেও মনের ভেতরে দ্বিধা আর সংশয় কাজ করছে। এত এত বছরের দূরত্ব আর বদলে যাওয়া জীবনের বাস্তবতা কি সহজেই সামনাসামনি বসার আড়ষ্টতা ভাঙতে পারবে? তবু উত্তরে লিখল, 'দেখা তো করা যেতেই পারে। কবে, কোথায়?' রেহেনুমা মুচকি হাসির ইমোজি দিয়ে লিখল, 'যেদিন অলকানন্দা ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবা।' আদিব অবাক হয়ে জানতে চাইল, 'অলকানন্দা?' 'আগের মতো এখনো এমন বায়না কর? শর্ত জড়ানো বায়না?' 'কেন করব না? তুমি ছাড়া আর কার কাছে বায়না করব?' 'আনতে পারলে দেখা হবে। না পারলে!' আদিব মনে মনে হাসল! কফিশপের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল আদিব। রেহেনুমার চোখে চোখ পড়তেই মৃদু হাসল। সেই পরিচিত হাসি, যেন প্রতিদিনই তাদের দেখা হয় এখানে। কফিশপের এক কোণে জানালার পাশে রেহেনুমা বসা। সামনে রাখা চায়ের কাপ আর আধখাওয়া একটা কেকের টুকরো। 'তুমি সত্যিই অলকানন্দা নিয়ে এসেছ?' মৃদু হেসে আদিব বলল, 'তুমি বলেছ, না এনে উপায় আছে?' আদিব হাতে থাকা তোড়াটা টেবিলের ওপর রাখল। অলকানন্দার গাঢ় হলুদ পাঁপড়ি আর সঙ্গে জড়ানো সবুজ পাতার শোভা কফিশপের পরিবেশটাকে মুহূর্তেই মোহনীয় করে তুলল। রেহেনুমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, 'এই ফুলের মানে জান, আদিব?' 'জানি,' আদিব বলল। 'অলকানন্দা মানে আনন্দ। এমন এক আনন্দ যে নিজের ভেতরে বিষণ্নতা লুকিয়ে রাখে। বিষণ্ন আনন্দ। এই ফুলের গল্পটা এখন হারিয়ে গেছে, ঠিক আমাদের গল্পের মতো।' অনেকদিন পর সামনাসামনি বসে কথা বলার শুরুটা একটু দ্বিধা আর সৌজন্য জড়ানো হলেও চায়ের কাপে চুমুকের পর কথাগুলো যেন নিজেরাই বেরিয়ে আসতে শুরু করল। 'দিনকাল কেমন কাটছে তোমার?' রেহেনুমা জিজ্ঞেস করল। 'খারাপ না,' আদিব উত্তর দিল। 'ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে যায়। লেখালেখি, ঘর-সংসার, বাচ্চা- সব মিলিয়ে একটা ছকে আটকে আছি। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, কী যেন একটা নাই।' রেহেনুমা আদিবের দিকে গভীর আবেগে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'কী যেন একটা? নাকি কেউ যেন একটা?' আদিব খানিক্ষণ চুপ করে থাকল। তার বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠল। 'মনে হয়, কেউ একজন,' সে ধীরে ধীরে বলল। 'কিন্তু আমাদের সময় গিয়েছে চলে বদলের জলে। সময় আমাদের অনেক বদলে দিয়েছে রেহেনুমা।' রেহেনুমা মৃদু হেসে বলল। 'সময় মানুষকে বদলায় না, আদিব। মানুষ শুধু সময়কে মেনে নেয়, মানিয়ে নেয়।' গল্পের স্রোত চলতে চলতে গিয়ে আটকে গেল ষোল বছর আগের সেই শেষ বিকেলে। 'সেদিন তুমি চলে গেলে কেন?' আবেগঘন কণ্ঠে রেহেনুমা জিজ্ঞেস করল। আদিব চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, 'আমি ভেবেছিলাম, সম্পর্কগুলো শুধু ভালোবাসার মধ্যেই আটকে থাকে না। ভালোবাসার সাথে প্রয়োজন হয় সমঝোতা আর সহনশীলতা। আমাদের মধ্যে সেটা ছিল না। ভেবেছিলাম, দূরে গেলে হয়তো আমরা নিজেদের বুঝে খুঁজে নিতে পারব। কিন্তু সেটা আর হলো কই?' 'তুমি জান, আমি তোমার চলে যাওয়াকে মেনে নিতে পারিনি। অনেকবার চেষ্টা করেছি নিজেকে বোঝাতে। কিন্তু...' কফিশপের জানালা গলে এক ঝলক আলো এসে পড়ল। গোধূলির শেষ আলো। রেহেনুমা অলকানন্দার ফুলগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। 'এই ফুল শুধু ফুল নয়, জান? এগুলো আমাদের অনেক না বলা কথার গুচ্ছ। আমরা কেউই সেই ভাষা পুরোপুরি বুঝিনি কখনো আর কোনো দিন বুঝবও না হয়তো।' আদিব কোনো কথা না বলে চুপ করে রেহেনুমার কথাগুলো শুনছিল শুধু।