বৈষম্যবিরোধী মানবতার কবি নজরুল

প্রকাশ | ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

শেখর ভট্টাচার্য
কাজী নজরুল ইসলাম কেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি? নজরুলের সৃষ্টিশীল কর্মকান্ড, নজরুলের জীবন দর্শন, জীবন আদর্শ কতটুকু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। কবিদের বলা হয় ত্রিকালদর্শী অর্থাৎ তারা সমকালে অবস্থান করে বর্তমানকে যেমন দেখতে পান, একইভাবে ভবিষ্যতকেও সমান ভাব দেখতে ও অনুভব করতে পারেন। বিস্ময়ের ব্যাপার, কাজী নজরুল ইসলাম তার জীবনের মাত্র বাইশ বছর সাহিত্য সৃষ্টির সময় পেয়েছেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ বছর অর্থাৎ ১৮৯৯ সালে আর তার সচেতন সত্তা সক্রিয় ছিল ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি তার বিখ্যাত কবিতা 'বিদ্রোহী' রচনা করেন আর কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। অনেক গবেষক নজরুলের সাহিত্য সৃষ্টির সময় হিসাবে ১৯২২ থেকে ১৯৪২ সাল অর্থাৎ এই বাইশ বছরকে চিহ্নিত করেন সুবর্ণ সময় হিসেবে। নজরুল পূর্ব, বাংলাসাহিত্যে রোমান্টিকতার প্রাবল্য যত বেশি ছিল, দৃঢ়তার পরিমাণ সে তুলনায় অনেক কম ছিল। নজরুল তার বিচিত্র রচনা সম্ভারের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে দৃঢ়তা, কাঠিন্য বা শক্তিময়তার যে অভাব ছিল সেই শূন্যতা তার স্বভাবজাত লেখনীর মাধ্যমে পূরণ করেন। প্রশ্ন হলো নজরুল তার সৃষ্টিশীল সচেতন সত্তা দুরারোগ্য ব্যধির কারণে হারিয়ে ফেলেন ১৯৪২ সালের আগস্টে আর বাংলাদশের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ৮ মার্চ ভাষার প্রশ্নে; তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার বিষয়টি তার সাহিত্য সৃষ্টিতে কি করে এলো? আর যদি নাইবা এসে থাকে অথবা তিনি বাংলাদেশকে তার সাহিত্যে ধারণ না করে থাকেন; তাহলে তিনি কেন এবং কীভাবে বাংলাদেশের জাতীয় কবি? কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন স্বাধীনতা গণতন্ত্র মানবতা, ন্যায্যতা অর্থাৎ সুবিচারের কবি। নজরুল তার লেখনীতে যে সাম্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন তা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবতা এবং সুবিচারের প্রত্যয়ে তীক্ষ্ন, তীর্যক, উজ্জ্বল। তার কল্পনা কখনো ধর্মীয় উদারতা, কখনো সাম্যবাদ, কখনো স্বাধীনতা, কখনো মানবতাকে স্পর্শ করেছে। সমাজ-বিধানের অসঙ্গতি, স্ববিরোধিতা, জাতিবৈষম্য, শ্রেণি বৈষম্যের প্রতি তার কণ্ঠ সব সময়ই সোচ্চার ছিল। আর এসব কিছুর মূল ছিল মানবমুক্তি ও মানবকল্যাণ। 'কুলি-মজুর' কবিতায় তার মানবতার পরিচয় ফুটে উঠেছে- 'দেখিনু সেদিন রেলে/ কুলি বলে এক বাবুসাব তারে টেনে দিল নিচে ফেলে/ চোখ ফেটে এলো জল/ এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল।' নজরুল মানুষকে জাতির ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। তিনি জাতির স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে একাত্ম করে নির্যাতিত শ্রেণির মুক্তির কথা ভেবেছেন। নজরুল বিদ্যমান ব্যবস্থায় যে বৈষম্য ছিল, সে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার অধিকাংশ সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা ঘটে ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্য সৃষ্টির প্রয়াস থেকে। শতকরা সাত ভাগ মানুষের মুখের ভাষা উর্দুকে যখন রাষ্ট্রভাষা করার দৃঢ় ঘোষণা শোনা গেল, সেই থেকে বাঙালি স্বতঃস্ফূর্ত লড়াইয়ে রাজপথে নামে। সেই লড়াই যে তাদের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথের দিকে নিয়ে যাবে তা' ছিল অজানা। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালি রাজনীতিবীদ ও নাগরিক সমাজ আঁচ করতে পারলেন ভাষার প্রশ্নে বৈষম্য সৃষ্টির এই কূট চাল মূলত পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনকে মজবুত করারি প্রাথমিক পদক্ষেপ। মূলত সাম্প্রদায়িকতার খোলসকে সামনে নিয়ে এসে বাংলা ভাষাকে শেকড় ছাড়া করার প্রয়াস চালানো হয়। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে সঙ্গে নিয়ে ঔপনিবেশ স্থাপনের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাঙালি রুখে দাঁড়ায়- রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবিদের চেতনা ধারণ করে। নজরুল ছিলেন স্বাধীনচেতা মুক্ত মনের মানুষ। হিন্দু-মুসলিমের সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালির ঐক্যের স্বপ্ন দেখেন। ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র রজতজয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতি রূপে কাজী নজরুল ইসলাম একটি অভিভাষণ প্রদান করেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে চিরজীবনের জন্য বাক্‌?রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পূর্বে এই ছিল তার সর্বশেষ বক্তৃতা। কবি তখন ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। তিনি কুণ্ঠিত, দ্বিধান্বিত হিন্দু-মুসলমানের আলগা বন্ধন দেখে; আবার সাহিত্য তার প্রকৃত লক্ষ্যে কতখানি অগ্রসর হচ্ছে, তা নিয়েও তিনি বেশ শঙ্কিত ছিলেন। তাই কবি সেদিন তার অভিভাষণে বলেন, 'কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটো কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তা হলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে, আমার গাঁটছাড়ার বাঁধন কাটতে কোনো বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আর একজনের আস্তিনে আছে ছুরি। বর্তমানের সাহিত্য নিয়ে ধুলোবালি, এত ধোঁয়া, এত কোলাহল উঠেছে যে ওর মাঝে সামান্য দীপ-বর্তিকা নিয়ে পথ খুঁজতে গেলে আমার বাতিও নিভবে, আমিও মরব।' নজরুল বললেন, 'জাগো নিপীড়িত, জাগো কৃষক, জাগো শ্রমিক, জাগো নারী'। এখানেই তার স্বাতন্ত্র স্পষ্ট এবং এখানেই তিনি যুগোত্তীর্ণ। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রেরণা মূলত নজরুলের স্বতঃস্ফূর্ত অসাম্প্রদায়িকক চেতনারই প্রতিধ্বনি। যে অসাম্প্রদায়িকতা চতুর্দশ শতাব্দীর কবি চন্ডীদাস ধারণ করতেন সে চেতনারই ধারাবাহিকতা হলো নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা। চন্ডী দাস যেমন বলেছিলেন, 'শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।' নজরুল আরও এগিয়ে গিয়ে বলেন, 'গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান'। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনও এই চেতনা ধরে এগিয়ে গিয়েছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সুতিকাগার। চতুর্দশ শতাব্দীর চন্ডীদাস, ঊনবিংশ/বিংশ শতাব্দীর নজরুল এবং বাঙালির স্বকীয়তার আন্দোলন এক হয়ে যায়, চেতনার বহ্নি শিখায়। নজরুল হয়ে যান বাংলাদেশের সমার্থক। নজরুলকে বাংলাদেশ থেকে আর বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ থাকে না। নজরুল সারাটি জীবন বৈষম্যে সৃষ্টির রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন। বুর্জোয়া সামন্ততন্ত্রের পরিবর্তে তিনি চেয়েছেন সাম্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়তে। তাই তাঁর বিভিন্ন কাব্যে মানবতাবোধ থেকেই এসেছে বিদ্রোহ, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদের চেতনা। তিনি মনে করতেন- যা কিছু মানুষের জন্য সুন্দর, মহোত্তম ও কল্যাণকর তাই ধর্ম। নজরুল-মানস পরিমন্ডল সার্বজনীন মানবতাবোধ দিয়ে বেষ্টিত। তিনি মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করলেন কল্পনার উচ্চমার্গ থেকে প্রত্যক্ষ জীবনে জনসাধারণের স্তরে। সমাজে যারা নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত, অপমানিত তারাই কবিচিত্তকে আকৃষ্ট করেছে। এসব মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে লাঘব করতে তার লেখনী নিসৃত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনও ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে একটি গণ-আন্দোলন ছিল। নজরুলের সাম্যের ধারণা খুব সহজেই বাংলাদেশের মানুষের চেতনার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। যখন শোষণের বিষদাঁত বাঙালিদের দেহে আঘাত করে। বাংলাদেশের দরিদ্র, পরিশ্রমী কৃষকের ফলানো পাট বিক্রি করে যখন পাকিস্তানের নতুন রাজধানী ইসলামাবাদ গড়ে তোলা হয়, তখন মানুষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং সাম্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। এই আন্দোলনের প্রাণ শক্তি বাঙালি গ্রহণ করে নজরুলের অসংখ্য কবিতার চরণ থেকে। কী আশ্চর্য আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে নজরুল সক্রিয়ভাবে না থেকেও চেতনায় সক্রিয়ভাবে উপস্থিত হন। বাঙালি লড়াই করে নজরুলের চেতনাকে সঙ্গী করে। নজরুলের গান, কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র- এককথায় সমগ্র নজরুল সাহিত্যে দুটি ভাবকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। প্রথমটি, সমাজের নানাবিধ বৈষম্যের প্রতি তার তীব্র ক্ষোভ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের প্রতি তার অপার ভালোবাসা। প্রথমটি থেকে তার মধ্যে জন্ম নেয় সাম্যবাদী চেতনা আর দ্বিতীয়টি থেকে জন্ম নেয় বিশ্ব মানবধর্ম। সাম্যবাদী চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং সমাজে সব মানুষের সমান অধিকার অর্থাৎ গণতন্ত্রকে হৃদয়ে বহন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ এগোতে থাকে। আর এসব আদর্শ বহন করে নজরুলের সৃষ্টিশীল কর্মকান্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে পথ চলতে থাকে। নজরুল এক সময় হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির চেতনার বহ্নিশিখা। যে শিখায় প্রেম, দ্রোহ, সংগ্রাম, অনায্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নদীর স্রোতের মতো বয়ে চলে। নজরুলকে তাই স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি হতে হয় স্বতস্ফুর্ত ভাবে। কারণ নজরুলের চেতনাবিহীন বাংলাদেশ আর পদ্মার ঢেউবিহীন পদ্মার সমতুুল্য হয়ে দাঁড়ায়। নজরুল তাই আমাদের জাতীয় কবি না হয়ে উপায় থাকে না।