হালখাতা আয়োজনে ব্যস্ত পুরান ঢাকা

প্রকাশ | ১৩ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
নতুন খাতা তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকরা -যাযাদি
বাংলা নতুন বছরের (১৪২৬) যাত্রা শুরু একদিন পরই। আর এই নববর্ষকে বরণ করে নিতে বরাবরের মতো নানা আয়োজন হাতে নিচ্ছে বাঙালি। এ আয়োজনের অন্যতম উৎসব পহেলা বৈশাখের হালখাতা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতা খোলার যাত্রা শুরু হবে বৈশাখের প্রথম প্রহরে। লাল মলাটের পঞ্জিকা দেখেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করেন ব্যবসায়ীরা। একইসঙ্গে লাল মলাটের নতুন খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয় নতুন বছরের হিসাব। পুরান ঢাকায় হালখাতা উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা। ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য প্রস্তুতির কোনো কমতি দেখা যায়নি তাদের মধ্যে। পুরানো ময়লা-আবর্জনা ধুয়েমুছে সাফ করা হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রং করানো হচ্ছে। টাঙানো হচ্ছে বেলুনসহ নানা ধরনের বর্ণিল সামগ্রী। দোকানের সব জিনিসপত্র নামিয়ে সাজানো হচ্ছে নতুনভাবে। টালি (লাল রঙের হিসাবের খাতা) বিক্রেতারা বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ২০০ থেকে শুরু করে হাজার টাকায় টালি কিনছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া দোকানে দোকানে ঝুলছে মঙ্গলঘট, সোলার ফুল, মালাসহ নানা উপহার সামগ্রী। আগের মতো হালখাতা উৎসবের জৌলুস না থাকলেও ব্যবসায়ীরা ঐতিহ্য হিসেবেই পালন করছেন এখনো। শুক্রবার হালখাতা উপলক্ষে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতিবাজার, ইসলামপুর, চকবাজার, শ্যামবাজার ও বাবুবাজারের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে এমন তথ্য। ঘুরে দেখা গেছে, পুরান ঢাকার দোকানে দোকানে এখন উৎসবের আমেজ। ছোট কিংবা বড়- সব দোকানেই উৎসব উৎসব ভাব। দোকানে দোকানে রং করা থেকে শুরু করে মালামাল পরিষ্কারে নেমেছেন মালিক-কর্মচারীরা। অনেক ব্যবসায়ী হালখাতা উপলক্ষে বিভিন্ন রং দিয়ে দোকানে সাজসজ্জা করছেন। এছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি তারা পুরাতন খাতার সব লেনদেনের হিসাবও করছেন। অনেক দোকানের ব্যবস্থাপক আমন্ত্রণপত্রের ওপর পাওনাদারের নাম লিখছেন। অনেকে আবার মিষ্টির দোকানে পহেলা বৈশাখের দিনের জন্য অর্ডার দিচ্ছেন। হালখাতা যেন সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারেন, সেদিকেই ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় নজর। তবে দোকানগুলোতে ক্রেতাদের তেমন ভিড় নেই। পহেলা বৈশাখ আসা পর্যন্ত তেমন একটা কেনাবেচা না হলেও মঙ্গলঘট, সোলার ফুল, মালা, নতুন শীতলপাটি, কার্পেট বিক্রি বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। শাঁখারীবাজারের গৌর নিতাই শঙ্খভান্ডারে গিয়ে দেখা গেছে, স্তূপ করে রাখা সাদা রঙের সোলা। 'শুভ হালখাতা'সহ বিভিন্ন শব্দ দিয়ে তৈরি করা বোর্ড এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বৈশাখ উপলক্ষে প্রায় মাসব্যাপী তাদের ব্যস্ত থাকতে হয় বোর্ডে শুভ হালখাতাসহ নানা ধরনের লেখালেখিতে। শুধু পুরান ঢাকা নয়, রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা থেকেও এমন কারুকাজ কিনতে আসেন ব্যবসায়ীরা। এখানকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী মাধপ পাল জানান, এ মাসটির জন্য তারা আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করেন। কাস্টমার হচ্ছে তাদের লক্ষ্ণী। সারাবছর যারা বাকি স্বর্ণালঙ্কার কেনেন, তারা পহেলা বৈশাখে প্রায় সব টাকা পরিশোধ করেন। তিনি বলেন, 'আমরা হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী বর্ষবরণ উৎসব করে থাকি। তাই আমাদের পহেলা বৈশাখ একদিন পরে হয়। আমরা এই দিনে শিব ও চড়কপূজা করি।' তাঁতিবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী শ্যামল সিং জানান, বিদায়ী বছরের হিসাবনিকাশ চলছে। বছর শেষে লাভ-লোকসানের হিসাব করে পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন খাতা খোলার মধ্য দিয়েই হালখাতা করা হয়। তবে আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা তাদের হিসাবনিকাশ কম্পিউটারে রাখছেন। যদিও টালিতে সব হিসাবই লেখা হয়। টালি থেকে পরে কম্পিউটারে পোস্টিং হয়। অনেক ক্রেতা না আসতে পারলেও মোবাইলের মাধ্যমে বিকাশেও টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন হালখাতার। বর্তমান সময়ে দোকানে অপ্যায়ন হয় খুব কম। বিভিন্ন নামিদামি হোটেলে ক্রেতাদের খাওয়ানো হয়। ক্রেতারা খাওয়াদাওয়া শেষে দোকানে এসে বাকি টাকা দিয়ে যান। দোকানদারও ক্রেতাদের আপ্যায়নের পাশাপাশি বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দেন। ফেনী থেকে আসা শীতলপাটি বিক্রেতা মিন্টু মিয়া বলেন, 'গত ১০ বছর ধরে তাঁতিবাজারে শীতলপাটি বিক্রি করি। প্রায় ৫০০ শীতলপাটি নিয়ে এসেছি। বড় একটি পাটির দাম পড়বে ৬০০ টাকা। মাঝারিটার দাম ৪৫০ টাকা। এর থেকে একটু ছোটটার দাম ৩০০ টাকা এবং একেবারে ছোটটার দাম পড়বে ২০০ টাকা। ইতোমধ্যেই প্রায় অর্ধেক পাটি বিক্রি হয়ে গেছে।' আগামী দুদিনে সব বিক্রি হয়ে যাবে। প্রয়োজনে আরও আনা হবে বলে জানান তিনি। ইসলামপুরের পাইকারি কাপড়ের ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক নাসির উদ্দিন মোলস্না বলেন, 'পহেলা বৈশাখের দিন আমরা হালখাতা উপলক্ষে সকাল ৮টায় দোকান খুলি। এরপর সকাল ১০টায় মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করি। তারপর আমন্ত্রিত অতিথিদের টাঙ্গাইলের চমচম ও নিমকি দিয়ে আপ্যায়ন করি। বছরের সব দেনা-পাওনার হিসাব নিষ্পত্তি করে পুরানো জঞ্জাল সরিয়ে নতুনভাবে বছর শুরু করি।' তিনি বলেন, এখন আগের মতো ঘটা করে হালখাতা পালন করা হয় না। রীতিতে নতুনত্ব এসেছে। এখন ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন উপহার দেন। দোকানের নাম লেখা বিভিন্ন উপহার তৈরি করতে থাকেন মাসখানেক আগে থেকেই। একসময় পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দোকানে গান-বাজনাসহ রান্না হতো নানা রকমের খাবার। পর্যাপ্ত মিষ্টিও রাখা হতো। আগের সেই আমেজটা এখন আর পাওয়া যায় না। শ্যামবাজারে গিয়ে কথা হয় হৃদয় টেডার্সের স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলাম খানের সঙ্গে। তিনি জানান, শ্যামবাজারের বৈশাখ আর পুরান ঢাকার মধ্যে কিছুটা আলাদা আমেজ থাকে। দুই সপ্তাহ আগে থেকেই এ বাজারে হালখাতা শুরু হয়ে যায়। তবে পহেলা বৈশাখের দিন বড়সর করেই অনুষ্ঠান হয়। ক্রেতাদের সুবিধার্থে প্রায় ১৫ দিনব্যাপী তারা অনুষ্ঠান করেন। তিনি বলেন, এ বাজারে কৃষি ও কাঁচাবাজারের মালামাল বেশি। একজন ক্রেতা পাঁচ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত বাকি পরিশোধ করেন। তাদের স্টার হোটেলসহ বিভিন্ন হোটেলে খাবার খাওয়ানো হয়। মূল্যবান উপহার সামগ্রী দেয়া হয়। ক্রেতার পরিবারের জন্যও উপহার দেয়া হয়। এদিকে, পুরান ঢাকার চকবাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট-বড় দোকানগুলোতে উৎসবের আমেজ। নানা সামগ্রী বিক্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে দোকান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। সাজানো হচ্ছে ওয়াল, টাঙানো হচ্ছে ডিজিটাল ব্যানার। এখানকার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে দোকানে দোকানে খুব একটা খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয় না। এটি এখন রেস্টুরেন্টগুলোয় গিয়ে ঠেকেছে। মা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী পরিমল চন্দ্র মন্ডল বলেন, আমরাও চাই ক্রেতাদের ভালো করে খাওয়াতে। ক্রেতাদের জন্য আমরা পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে বড় বড় পার্টির আয়োজন করি। এ আয়োজন সপ্তাহব্যাপী চলে। অন্যদিকে, নয়াবাজার জিবি বাইন্ডিংয়ের স্বত্বাধিকারি জাহাঙ্গীর বলেন, গত দুই মাস ধরেই ব্যস্ত সময় পার করছি। রাত-দিন কাজ চলছে। প্রতি বছরই এমন সময় আমাদের বেচাকেনা পুরোদমে থাকে। এবারও এর বিকল্প নয়। এ বছর বেচাকেনা অন্য বছরের তুলনায় ভালো হচ্ছে বলে জানা গেছে। সর্বজনীন উৎসব হিসেবে হালখাতা বাংলা নববর্ষের প্রাণ। ইতিহাস বলে, ১৫৮৪ সালে সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই হালখাতার প্রচলন হয়।