পরিচ্ছন্নতাকমীর্র গল্প

ময়লাতেই মিশে যায় ওদের ঈদ আনন্দ!

প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

ফয়সাল খান
ঈদের দিন নতুন জামা পরা বা সুগন্ধি লাগানো হয় না ২০ বছর ধরে। রাত ১০টার আগে ভালো কোনো খাবারও জুটে না। আমাদের সমাজ বাস্তবতায় ঈদের এমন চিত্র অস্বাভাবিক হলেও গত ২০টি কোরবানির ঈদ এভাবেই পার করেছেন রাজধানীর ধলপুরের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম (৫০) ও আবদুর রহিম (৬০) দম্পতি। কোরবানির ঈদের আগের রাত থেকে ঈদের দিন রাত পযর্ন্ত কোরবানির পশুর ময়লা পরিষ্কার করতেই কেটে গেছে তাদের জীবনের ঈদ আনন্দ। আলাপকালে প্রতিবেদককে এই দম্পতি জানান, তিন মেয়ে আর দুই ছেলে নিয়ে তাদের সংসার। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশনে মাস্টার রোলে পরিচ্ছন্নতাকমীর্র চাকরি নেন। দিনরাত নগর পরিচ্ছন্নতায় কাজ করে গেলেও কোনো স্বীকৃতি পাননি। এমনকি চাকরিটা পযর্ন্ত স্থায়ী হয়নি। ঈদের দিন কাজ করার জন্য আলাদা কোনো সম্মানীও পান না। শুধু আনোয়ারা-আবদুর রহিম দম্পতিসহ রাজধানীতে কোরবানির পশুর বজর্্য অপসারণে নিয়োজিত প্রায় ২১ হাজার পরিচ্ছন্নকমীর্র ঈদের গল্পটা এমনই। নিজেদের ঈদ আনন্দ মাটি করে সারা দিনরাত পরিশ্রম করে নগরীর অলি-গলি পরিচ্ছন্ন করে তোলেন তারা। অথচ সামাজিকভাবে স্বীকৃতি তো দূরের কথা, সুইপার কোলোনি ছাড়া অন্য কোথাও বাসাও ভাড়া পান না। সোমবার কথা হয় এমন আরও এক দম্পতির সঙ্গে। তারাও প্রায় ২০ বছর ধরে মাস্টার রোলে কাজ করছেন। ঈদের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘আমাদের কাছে ঈদ মানে ময়লা সাফ করা।’ তিন সন্তানের জননী শিল্পী আক্তার জানান, ঈদের আগের দিন রাত থেকে কাজে নামতে হয়। ঈদের দিন রাত ১০টার আগে ঘরে যেতে পারেন না। সন্তানদের দেখাশোনা বা খাওয়ার খবরও নিতে পারেন না। কষ্ট হলেও পেটের দায়ে কাজ করতে হয় বলে জানান তিনি। ঈদের দিনের খাবার সম্পকের্ জানতে চাইলে তার স্বামী বেলাল হোসেন বলেন, খাবার খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সকালে রাস্তা ঝাড়– দিয়ে কোরবানির বজর্্য পরিষ্কারের প্রস্তুতি নিতে হয়। ঈদের দিন থাকায় দোকাপাট সব বন্ধ থাকে। এরপরও পেটের খিদা নিবারনের জন্য কিছু খেয়ে নেন। তবে তা ঈদের স্পেশাল কোনো খাবার না। গত ঈদে রুটি-কলা খেয়েছিলেন বলে জানান তিনি। আরেক পরিচ্ছকমীর্ সালেহা আক্তার (৫৫) জানান, রাতের আগে ঈদের ঘ্রাণ পান না। রাতের বেলায় বাসায় ফিরে গোসল করে কিছু ভালো খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন ভোরে আবার বের হতে হয়। নগরীর রাস্তাঘাট ঝাড়– দিয়ে ২৫ বছর কাটিয়ে দেয়া এই নারী আক্ষেপ করে বলেন, ঈদের দিন ভালো খাবার তো দূরের কথা, ভালো ব্যবহারও ঝুটে না। গত কোরবানির ঈদে কয়েকজন বাড়িওয়ালা খুবই দুবর্্যবহার করেছে। প্রায়ই মানুষের অবজ্ঞা সহ্য করতে হয় বলে জনান তিনি। পরিচ্ছন্নকমীের্দর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধুমাত্র ঈদই নয়, প্রায় সারাবছরই মানুষের দুবর্্যবহারের শিকার হন তারা। নিজেদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়েও নগরীর অলি-গলি পরিচ্ছন্ন রাখতে দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করলেও সমাজের মানুষ আড় চোখেই দেখে তাদের। এলাকায় তাদের সুইপার বা মেথর বলে সম্বোধন করে অনেকেই। নিজেদের সঙ্গে তো দূরের কথা, তাদের সন্তানদের সঙ্গেও অন্য পেশার কারও ছেলেমেয়েকে মিশতে দেয় না। সামাজিকভাবে ঘুরে দঁাড়ানোর ন্যূনতম সুযোগ না থাকায় তাদের সন্তানরাও বাধ্য হয়ে এই পেশায় চলে আসেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নকমীর্রা বেতন-বোনাসসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেলেও মাস্টার রোলের কমীর্রা বছরের পর নামমাত্র পারিশ্রমিকে কাজ করে যাচ্ছেন। ৩০-৩৫ বছর ধরে কাজ করেও চাকরি স্থায়ী হয়নি অনেকের। এমনও পরিচ্ছন্নকমীর্ আছেন, যারা অন্যের বদলে কাজ করে দিচ্ছেন। সিটি করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত বেতনের খুবই সামান্য পান তারা। কাজ না করেও বাকি টাকা নিয়ে নেয় নিয়োগপ্রাপ্তরা। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে দৈনিক মুজরিভিত্তিক পরিচ্ছন্নকমীর্ নিয়োগ দেয়া হয়। যারা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিনের জন্য মাত্র ৪৭৫ টাকা করে পান। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অস্থায়ী পরিচ্ছন্নকমীের্দর জন্য ঈদসহ অন্যান্য উৎসবে মেয়রের ঐচ্ছিক তহবিল থেকে উৎসব ভাতা দেয়া হয়। যার পরিমাণ ১০০০ -১৫০০ টাকা। সিটি করপোরেশনের বজর্্য ব্যবস্থাপনা বিভাগসহ বেশ কয়েকটি বিভাগের কমর্কতার্রা-কমর্চারীরাও পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারেন না। এর জন্য কাউকে অতিরিক্ত কোনো টাকা দেয়া হয় না। সবাই যার যার দায়িত্ব পালন করছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বজর্্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নিবার্হী প্রকৌশলী আ হ ম আবদুল্লাহ হারুন যায়যায়দিনকে বলেন, ঈদের আগের দিন সন্ধ্যার পর থেকেই কোরবানির বজর্্য পরিষ্কারে নেমে পড়তে হয়। হাট থেকে বাসাবাড়ি পযর্ন্ত কোরবানির পশু নিয়ে যাওয়ার ফলে রাস্তাঘাটসহ সবর্ত্রই পশুর মলমূত্র ও আবজর্না পড়ে থাকে। রাতে কোরবানির পশুর হাট ও রাস্তাঘাট থেকে এসব পরিষ্কার করতে হয়। এগুলো করতে প্রায় ১২-১টা বেজে যায়। পরদিন আবার ১০টা থেকে কাজ শুরু করে। ঈদের দিন রাত ১০টার আগে কেউ বাড়ি ফিরতে পারে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, কোরবানির ঈদে পরিচ্ছন্নকমীের্দর একটু বেশিই কষ্ট হয়। ঈদের মতো একটি উৎসবের আনন্দ ত্যাগ করে যারা ময়লা সাফ করেন, তাদের আরও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা উচিৎ বলে মনে করেন এই কমর্কতার্। এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কমর্কতার্ বি. জে. মো. জাকির হাসান যায়যায়দিনকে বলেন, ঈদের দিন অন্যান্য বিভাগের কমর্কতার্-কমর্চারীরাও কাজ করেন। তাদের অতিরিক্ত কোনো ভাতা প্রদান করা হয় না। পরিচ্ছন্নকমীর্রাও সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন।