নারী-পুরুষ মিলেই বিকশিত হয়েছে মানবসভ্যতা

প্রকাশ | ১১ জুন ২০২৪, ০০:০০

তানজিল আমির
মানবজাতিকে সমষ্টিগতভাবে নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। নারী-পুরুষ মিলেই পূর্ণ হয়েছে মানবসভ্যতা। নারী ও পুরুষের মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য মূলত কোনো বিভাজন নয়; বরং সৃষ্টির পূর্ণতা ও উৎকর্ষতার জন্যই একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সৃজিত জুটি সৃষ্টির অপরূপ ও মমতাময়ী সৃষ্টি নারীজাতি। পবিত্র কোরআনে নারীদের ব্যাপারে আলস্নাহর বাণী- হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন, আর বিস্তার করেছেন তাদের দু'জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। তেমনি আলস্নাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচনা করে থাক এবং আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। নিশ্চয় আলস্নাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন।' এটি সূরা নিসার প্রথম আয়াত। সূরা নিসা নামটিই প্রমাণ করে কোরআন নারী জাতিকে কী সম্মান দিয়েছে। মূলত এ আয়াতটি নারী জাতি সম্পর্কে ইসলামের ভাবধারা, ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পুরুষ ও নারীর পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য ও সম্পর্কের রূপরেখা সম্পর্কে পূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। আধুনিক যুগে নারীর স্বাধীনতা ও কর্মসংস্থান বিশ্বজুড়ে একটি আলোচিত বিষয়। কিন্তু ইসলাম ও হজরত মোহাম্মদ (স.) মানুষের স্বাধীনতা ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নে ছিলেন অনুপম আদর্শ। তিনি অমর্যাদা ও গস্নানির অতল গহ্‌বর থেকে তুলে নারীদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার উঁচু আসনে সমাসীন করেছেন। ইতিহাস পাঠে আমরা দেখি, নবী আমলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী তখন স্বপর্দায় নারীরাও জীবনযাপনের জন্য বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন। তবে সব ক্ষেত্রেই নারীরা তার শালীন ও নিরাপত্তা অনুকূল জীবনধারা অনুসরণ করেছেন। আলস্নাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে কারিমে সূরা নিসা নামে পূর্ণাঙ্গ একটি সূরা নাজিল করেছেন নারীর যাবতীয় স্বাধীনতা ও অধিকারের বার্তা নিয়ে। নারীরা আমাদেরই মা, বোন, স্ত্রী কিংবা কন্যা। তাদের হয়রানি বা নির্যাতন করা এবং তাদের অধিকার হরণ করা এবং অর্থনৈতিক ও কর্মের স্বাধীনতা হরণ করা মানেই তাদের মানবাধিকার হরণ করা, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আমাদের প্রত্যেকের উচিত, ইসলাম নির্দেশিত পথে নারীকে তার জীবন পরিচালনা ও অধিকার আদায়ে সহযোগিতা করা। ইসলাম কিন্তু পেশা গ্রহণে নারীকে বাধ্য করেননি, একইভাবে প্রয়োজনে নারীর উপার্জনকে হারাম বা নিষিদ্ধ করেনি। কর্মসংস্থান অর্থনৈতিক মুক্তি আনে ও স্বাধীন ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায়। আধুনিক যুগে নারীর কর্মসংস্থান বিশ্বজুড়ে একটি আলোচিত বিষয়। বস্তুত কোনো মানুষ স্বনির্ভর হতে পারে না কর্মসংস্থান ছাড়া। কারণ অর্থাভাবে মানুষ পরমুখাপেক্ষী হয়, তার ধর্ম সংকীর্ণ, বুদ্ধি দুর্বল এবং মানবতা বিনষ্ট হয়। তাই মানুষের স্বাধীনতা ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নে রাসুল ছিলেন একেবারেই আপসহীন। অমর্যাদা ও গস্নানির অতল গহ্‌বর থেকে তুলে ইসলাম নারীদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার উঁচু আসনে সমাসীন করেছেন। নারীর পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় অর্থনৈতিক ও কর্মের স্বাধীনতা ছিল বলেই রাসুলুলস্নাহ সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নামের যুগে বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সাহাবি হজরত যোবায়ের (রা.)-এর স্ত্রী, হজরত আবু বকর (রা.)-এর কন্যা আসমা (রা.)-এর সপর্দায় ঘোড়ার ঘাস সংগ্রহ করা, খেজুর বাগানের পরিচর্যা, খেজুরের আঁটি বহন করে বাড়ি আনা থেকে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতেন। হজরত জাবের ইবনে আবদুলস্নাহ খালা তালাকপ্রাপ্ত হলে তিনি খেজুর বাগান থেকে খেজুর সংগ্রহ করতেন। হজরত রাসুলুলস্নাহ (সা.) এটা জানলে বললেন, এতে কোনো ক্ষতি নেই। মহিলা সাহাবি ক্বিলাহ (রা.) বাজারে ব্যবসা করতেন। হজরত আবদুলস্নাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী ঘরে বসে শিল্পকর্ম করতেন এবং তা বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। ওহুদের যুদ্ধে উম্মে আম্মারা (রা.) শত্রম্নদের তরবারির ডজনখানেক আঘাত সহ্য করেও বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে রাসুল (সা.)-এর ওপর আক্রমণকারী শত্রম্নদের প্রতিহত করেছিলেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর সময় উম্মে শিফা নামক মহিলা বাজারের পরিদর্শক (আল হিসবাহ্‌) হিসেবে নিয়োজিত হন। রুফায়দা আল-আসলামিয়া প্রথম মহিলা ডাক্তার ছিলেন। রাসুল (সা.) খন্দকের যুদ্ধের সময় তাকে মদিনার মসজিদের পাশে তাঁবু টানিয়ে দিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি যুদ্ধাহত মুসলিম সেনাদের শুশ্রূষা করতেন। আশশিফা বিনতে আবদুলস্নাহ মুসলিম মহিলাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য বের হতেন। উম্মে মিজান নামক এক মহিলা হজরত রাসুলুলস্নাহ (সা.)-এর মসজিদে ঝাড়ু দিতেন। তার মৃতু্যর পর তিনি তার জানাজার নামাজ পড়ান। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'জয়নব আমাদের মধ্যে সবচেয়ে দানশীল। কারণ তিনি স্বহস্তে কাজ করতেন ও সদকা করতেন।' হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুলস্নাহ (সা.) নিজের সহধর্মিণী জয়নবের কাছে এসে দেখলেন, তিনি চামড়া পাকা করার কাজ করছেন।' সহিহ মুসলিম। এই হলো প্রিয় নবীর আমলে কর্মজীবী নারীদের অবস্থা। কিন্তু হাল সময়ে ইসলামের এই সোনালি ঐতিহ্যকে না জেনে, ইসলাম নারীকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে বলে প্রচার মূলতঃ অজ্ঞতারই পরিচায়ক। ইসলামে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা স্পষ্ট, প্রথমত নারীকে আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই। তাই শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে নারীর পিছিয়ে থাকারও কোনো অবকাশ নেই।