বেগম রোকেয়া এমন এক অসামান্য নারী, যিনি এদেশের অবহেলিত নারী সমাজকে দিয়েছেন এক অভাবনীয় আলোক বর্তিকার সন্ধান। বেগম রোকেয়া নারী অধিকার, চেতনা ও সমাজ নির্মাণ মানসিকতার যথার্থ রেখাপাত ঘটেছে তার সৃজনকর্মে। নারী জাগরণ তথা নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া এক প্রদীপ্ত শিখা। যার সংস্পর্শে এসে এই উপমহাদেশের নারী সমাজ লাভ করেছে মুক্তির দিশা। তিনিই প্রথম বাঙালি নারী যিনি নারী হয়ে প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এই উপমহাদেশে নারী সমাজের মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা। রোকেয়া প্রগতিশীলতা ও আধুনিকতার নামে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের আদর্শ ও ঐতিহ্যকে কখনো বিসর্জন দেন নাই।
বাংলার নারী সমাজের মুক্তির অগ্রদূত ও জ্ঞানের আলো সঞ্চারিনী বেগম রোকেয়া ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তর্গত 'পায়রাবন্দে' বিখ্যাত জমিদার সাবের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। পায়রাবন্দের প্রথম জমিদার টাটি বলদিয়া ইংরেজ পক্ষের গুপ্তচর ছিলেন ('বলদিয়া' অর্থ হলো বলদের পৃষ্ঠে মালামাল চাপিয়ে একস্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে গিয়ে ক্রয়-বিক্রয় করত যারা তাদের দেশীয় ভাষায় 'বলদিয়া' বলা হতো)। টাটি শেখ বলদিয়া তৎকালীন ইংরেজদের পক্ষে সফল গুপ্তচরের বদৌলতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মহাখুশী হয়ে তাকে কয়েক লাখ টাকার জমিদারি, লাখেরাজ, জলকর, ফলকর, বনকর দান করেন (হায়দার আলী রচিত 'পলাশী যুদ্ধোত্তর আযাদী সংগ্রামের পাদপীঠ' পৃষ্ঠা নং ৩৪০)। এখানে বেগম রোকেয়া পরিবারের সংক্ষিপ্ত বংশ পরিচিতি তুলে ধরা হলো: প্রপিতা মহ: টাটি চৌধুরী বলদিয়া (পরবর্তীতে চৌধুরী)। পিতামহ: জমির উদ্দিন চৌধুরী, পিতা- জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী সাবের চৌধুরী ও রাহাতুন্নেছা সাবেরা চৌধুরানী ছিলেন বেগম রোকেয়ার মাতা। তার মাতা রাহাতুন্নেছা, সাবেরা চৌধুরাণী ঢাকার বলিয়াদির জমিদার হোসেন উদ্দীন চৌধুরী সাহেবের কন্যা ছিলেন।
মরহুম স্বামীর নামানুসারে স্কুলের নাম দিয়েছিলেন 'সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল'। অভিভাবকদের আশ্বস্ত করে জানিয়েছিলেন স্কুলে কঠিনভাবে পর্দা মানা হবে। নিজে বোরকা পরে বাড়ি বাড়ি যেতেন ছাত্রী যোগাড় করতে। স্কুলের মিটিংও করতেন পর্দার অন্তরাল থেকে। এক পর্যায় স্কুলের ফান্ড শূন্য হলে তিনি বিত্তবানদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে স্কুল টিকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ ব্যাপারে রোকেয়ার হিতৈষীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খান বাহাদুর তসাদ্দক আহমেদ। ইতিহাসের পাতায় সেই ৮ জন ছাত্রীর নাম লিপিবদ্ধ থাকা দরকার। কেননা একটা যুগের পরিবর্তনে এরাই এগিয়ে এসেছিলেন মেয়েদের সার্বিক উন্নতির জন্য তিনি শিক্ষা গ্রহণকেই সর্বাগ্রে জোর দিয়েছিলেন, তার স্বপ্ন ছিল নারীকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। এরই জন্য তিনি ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে 'আঞ্জুমান খাওয়াতীনে ইসলাম' নামক মহিলা সংগঠন সে সময় কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শুধু সে সময় স্কুল ও 'আঞ্জুমান খাওয়াতীনে ইসলাম' নামক মহিলা সংগঠন তৈরির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নাই। বেগম রোকেয়া সে আমলে ছিলেন একজন নামকরা কবি ও সাহিত্যিক। মিসেস আর.এস হোসেন নামে সেকালের বিখ্যাত পত্রপত্রিকায় তিনি অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস ও নারীদের জন্য সমাজ সচেতনমূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩২ খ্রি.) সাহিত্য জগতে আবির্ভাব ঘটে বিশ শতকের প্রারম্ভে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে 'নব প্রভা' পত্রিকায় 'পিপাসা' শীর্ষক রচনার মাধ্যমে সাহিত্য জগতে তার আবির্ভাব।
বেগম রোকেয়ার উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থগুলোর নাম হলো- মতিচুর, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, সুলতানার স্বপ্ন (ইংরেজিতে লেখা), সুবেহ সাদেক, অর্ধাঙ্গী, জাগো হে ভগিনী, স্ত্রী জাতির অবনতি, গৃহ ইত্যাদি। রোকেয়া সাহিত্য রচনায় বেশিরভাগ সময় লিখতেন মিসেস আর.এস হোসেন। দাফতরিক চিঠি বা অনাত্মীয়দের কাছে চিঠি লিখতেও এ নামই স্বাক্ষর করতেন। একান্ত আপনজনদের কাছে লেখা চিঠিতে স্বাক্ষর করতেন 'রোকেয়া বা রোকেয়া খাতুন'।
রোকেয়ার সমাজ চিন্তা ও সমাজ পরিবর্তনের বিশ্বাস আধুনিক মতবাদে উজ্জীবিত। নারীর কাঙ্ক্ষিত মুক্তি সাধনে ও নারী শিক্ষায় উদ্দীপ্ত প্রাণ বেগম রোকেয়া তাই চিরকাল অম্স্নান হয়ে থাকবেন তার আপন কীর্তিও সৎকর্মের জন্য।
প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর থেকে ৩ দিনের জন্য মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া মেলা বসে। তখন মেলার পদভারে লোক সমাগমে এই এলাকাটি সরব ও কোলাহল মুখর হয়ে ওঠে। পায়রাবন্দে আরও রয়েছে বেগম রোকেয়া একাডেমি ভবন, রোকেয়া ডিগ্রি কলেজ ও বেগম রোকেয়ার জাদুঘর। জাদুঘরের থেকেও আকর্ষণ হলো বেগম রোকেয়ার মূল বসতভিটার ধ্বংস স্তূপ ঘিরে তৈরি উদ্যানটি। ইটের দেয়াল দিয়ে গাঁথুনি দেওয়া এই উদ্যানে ঢোকার মুখে রয়েছে একটি প্রবেশদ্বার। লোহার গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেই ভাঙ্গা ইটের প্রাচীর ও পিলার। পুরনো স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ ঐতিহ্যবাহী সাবের বংশের আভিজাত্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। বেগম রোকেয়ার আত্মত্যাগ কেবল স্কুল প্রতিষ্ঠা কিংবা আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কর্মী রোকেয়ার চেয়েও অনেক বড় ছিলেন সাহিত্যিক রোকেয়া।
এ প্রসঙ্গে রোকেয়ার স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে 'সওগাত' সম্পাদক নাসির উদ্দীন বলেছেন- 'বেগম রোকেয়া ছিলেন তৎকালীন মুসলমান নারী সমাজের স্বাধীনতার অগ্রদূত'। 'সওগাত' প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার উৎসাহ ছিল অবিস্মরণীয়। সওগাতের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রথম কবিতাটিও ছিল বেগম রোকেয়ার। (সওগাত প্রথম বর্ষ, প্রথম খন্ড, অগ্রহায়ণ ১৩২৫ বাংলা প্রথম সংখ্যা, ইংরেজি নভেম্বর ১৯১৮ খ্রি.)। লেখাটির সঙ্গে ছিল একটি চিঠি। আমি কবি নই, উৎসাহ দমন করতে না পেরে এটা লিখেছি। কবিতা হিসেবে হয়তো কিছুই হয়নি, তবে অভিনন্দন হিসেবে গ্রহণ করলে খুশি হবো। (তৎকালীন সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দীনকে উদ্দেশ্য করে লেখা)।
রোকেয়া এই উপমহাদেশে প্রথম মুসলিম নারীবাদী আন্দোলনের একজন প্রবক্তা ছিলেন এ কথা নিঃশংসয়ে বলা যায়। ১৯৮০ সালে বেগম রোকেয়ার শর্তবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে বাংলাদেশ ডাকবিভাগ তার দুটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশ ডাকবিভাগের এটি একটি মহৎ কাজ।
এই মহীয়সী নারী উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের জন্যই মূলত তার সাহিত্য সাধনায় স্থান করে নিয়েছেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন সে আমলে নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ও অগ্রদূত। আমাদের গর্ব। বাঙালির জাতি প্রেরণার উৎস। সত্য কথা বলতে কি বেগম রোকেয়ার কৃতিত্ব হলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোই। তিনি শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠা কিংবা নারী শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হন নাই; বরং সেই সঙ্গে ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে সমাজে মহিলাদের অবস্থার সার্বিক উন্নতির জন্য তিনি অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন পুরুষ ব্যক্তিত্ব। বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন নারী। এখানে বিদ্যাসাগরের চেয়ে বেগম রোকেয়ার কৃতিত্ব ছিল বেশি। সমকালীন সামাজিক অনুশাসনের অচলায়তন ভাঙা ছিল তার লক্ষ্য। সুবিধাভোগী পুরুষের বিরুদ্ধে তার ব্যাঙ্গ ছিল, কিন্তু নিছক পুরুষ বিদ্বেষ লালন করেন নাই নিজে অন্তরে। তাই নির্দ্বিধায় তার নামে সঙ্গে স্বামীর নাম যুক্ত করে নিজের সত্তাকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন।
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর শীতের ভোরে ফজরের নামাজের জন্য জায়নামাজে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ভোরের নামাজরত অবস্থায় তার মৃতু্য হয়। মাত্র ৫২ বছর বয়সে বেগম রোকেয়া ইন্তেকাল করেন। (১৮৮০-১৯৩২ খ্রি.) শোনা যায়, মৃতু্যর পর তার ইচ্ছা ছিল তার প্রাণের হাতে গড়া স্কুলের প্রাঙ্গণে কবর হবে এটি ছিল তার অন্তিম বাসনা। বলাবাহুল্য সে আশাও তার পূরণ হয়নি। সে আমলে এক শ্রেণির রক্ষণশীল গোড়া মুসলমান সমাজ সে সময় তাকে তার স্কুল প্রাঙ্গণে জানাজা ও কবর দিতে বাধা দিয়েছিলেন। পরে কলকাতার কাছে 'সোঁদপুরে' তার এক আত্মীয়ের বাগানবাড়িতে বেগম রোকেয়ার কবর দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। আজ তার চিহ্নমাত্র কোথাও বিদ্যমান নেই। যে নারী সারাটাজীবন তার সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে জাতির উন্নতির প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তার কবরটিও ধরে রাখার চেষ্টা করেন নাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিংবা বুদ্ধিজীবী মহল। সোঁদপুরের কাছে পানহাটিতে একটি স্কুলবাড়িতে বেগম রোকেয়ার কবর পাওয়া গেছে বলে কলকাতার বামপন্থি মহল থেকে একবার দাবি করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন ওমরকে দিয়ে দেড়যুগ আগে সেই কঙ্কালবিহীন কবরের উদ্বোধনও করা হয়েছিল। কঙ্কালটি নাকি স্কুল বাড়ি তৈরি করার সময় পাশের গঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে অনুসন্ধানে জানা গেছে এ দাবি অলীক সম্পূর্ণ ভুয়া। বর্তমানে বেগম রোকেয়ার উদ্বোধন করা সেই সমাধিটি এখনো রয়েছে কলকাতার সোঁদপুরের পানহাটির ওই স্কুল প্রাঙ্গণে। বিশ্বমানের বিচারে আমাদের মতো পিছিয়েপড়া সমাজে আজ বেগম রোকেয়া চর্চার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বেগম রোকেয়া শুধু নারীর অধিকার ও জাগতিক মুক্তির কথাই বলেন নই; প্রায় এক শতাব্দী আগে সাম্প্রদায়িকতাবিহীন মুক্ত জীবনবোধ ও জীবনাচরণের উৎসাহ দিয়েছিলেন।
বর্তমানে কলকাতার লর্ড সিনহা রোডে অবস্থিত বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল সরকারি বালিকা বিদ্যালয় আজও তার গৌরব ও ঐতিহ্য বহন করে চলছে।