শিল্প-কারখানা, কৃষি ও যানবাহনে তেল-কয়লা-প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদনের ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গমন বাড়ছে। শিল্পবিপস্নবের পর এই গ্যাস নির্গমন বেড়েছে ৩০ শতাংশ। গত আট লাখ বছরের মধ্যে এখন পৃথিবীর বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ এখন সবচেয়ে বেশি।
সমুদ্র জলে খাদ্য পিরামিডের সর্বনিম্ন স্তরে আছে পস্ন্যাঙ্কটন জাতীয় ক্ষুদ্র জীব, যারা অন্য জলজ প্রাণীদের আহার্য। উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পস্ন্যাঙ্কটনের সংখ্যা দ্রম্নত কমছে। অ্যান্টার্কটিকায় এমন বহু সামুদ্রিক প্রাণী ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছে, যারা ওখানকার পেঙ্গুইনদের মুখ্য খাদ্য। ফলে নানা প্রজাতির পেঙ্গুইনের সংখ্যা কমছে। সুমেরু অঞ্চলের সমগ্র বাস্তুতন্ত্রই আজ বিপণ্ন। খাদ্যাভাবে মেরুভালস্নুকদের ওজন এতটাই অস্বাভাবিক হারে কমছে যে, এরপর তাদের প্রজনন ক্ষমতা নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিপণ্ন প্রাণীদের তালিকায় আজ তারা শীর্ষে!
বরফগলা পানি সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলবর্তী ও দ্বীপ অঞ্চলে। লবণাক্ত জলের পরিমাণ বাড়ছে, মুখ্য বৃষ্টিপাত ঘটছে মৌসুমি বাতাস চলে যাওয়ার পর। এর ফলে যে সার্বিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, এতে সেখানকার বাঘ ও হরিণের (বার্কিং ডিয়ার) মতো অনেক প্রাণী আজ অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে প্রাণী দেহের বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। যেমন- বাসা বাঁধা আর মিলনের চিরাচরিত অভ্যাস। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে মাছ, কচ্ছপ, পরিযায়ী পাখিদের চলাচলের পরও।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, উষ্ণতা বৃদ্ধির এই বর্তমান ধারা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক চক্রেরই অন্তর্গত। উষ্ণ ও শীতল যুগের পর্যায়ক্রমিক আবর্তন পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। একুশ শতকের শেষে উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিমাণ নাকি হবে ২-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে পার্বত্য হিমবাহ ও মেরু অঞ্চলের বরফ আরও গলছে। এতে ডুবে যেতে থাকবে বেশ কিছু উপকূলবর্তী অঞ্চল।
বাংলাদেশেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপ থেকে গত এক দশকে প্রায় ১০ হাজার মানুষ কেবল এই কারণে ভিটে ত্যাগ করেছেন। অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলেও এই দৃশ্য মেলে। একদিক থেকে দেখলে প্রাকৃতিক ক্রমপরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়াই জৈব বিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি। যা সৃষ্টি করেছে এই বিপুল জৈব ঐশ্বর্য। সাম্প্রতিক সমস্যা কিন্তু অন্যত্র।
উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের অবদান। ফলে উষ্ণতা বৃদ্ধি তথা জলবায়ুর পরিবর্তনের ধারা এখন এতটাই দ্রম্নত যে, এর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না প্রাণীদের অভিযোজন শক্তি। অরণ্যছেদন, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের আধিক্য- এই প্রতিটি ঘটনার পেছনে আছে মানুষের ক্রিয়াকলাপ। এ নিয়ে রাজনৈতিক বাকবিতন্ডা যত চলেছে, সমাধানের লক্ষ্যে ততটা এগুলো যায়নি। মনুষ্যত্বের প্রাণীদের এই দুরবস্থা নিয়ে মানুষের উদাসীনতা বুমেরাং হয়ে তাদেরই আবার অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করাবে না তো
মাঝে-মধ্যেই নানা সমীক্ষার মাধ্যমে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা অদূর ভবিষ্যতের যে ভয়াল চিত্র তুলে ধরেন, তা যদি যথাযথ গুরুত্বসহকারে বিচার করে দ্রম্নত সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে চরম বিপদ থেকে রেহাই মিলবে না।
পৃথিবীতে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হয়, এর ১৫ শতাংশ আসে পশুপালন খাত থেকে। প্রতিবছর প্রাইভেট কার, ট্রেন, জাহাজ এবং বিমান থেকে যে পরিমাণ দূষণ তৈরি হয়, এই পশু পালন খাত থেকেও একই পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হয়।
লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাটাম হাউস বলছে, মাংস খাওয়ার পরিমাণ না কমালে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব হবে না। বিশ্বে মাংস খাওয়ার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি আমেরিকায়। সেখানে প্রতিদিন একজন ব্যক্তি গড়ে ২৫০ গ্রাম মাংস খায়। একজন মানুষের স্বাস্থ্যবান হওয়ার জন্য যে পরিমাণ মাংস খাওয়া প্রয়োজন, এটি তার চারগুণ। পৃথিবীর অনেক দেশে যেখানে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে, সেখানে মাংস খাওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে ২০৫০ সাল নাগাদ এই মাংস খাওয়ার পরিমাণ এখনকার চেয়ে ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর বিভিন্ন চর, মূল ভূ-খন্ডের সবুজ বনাঞ্চল ক্রমেই ধ্বংস হতে চলেছে। পটুয়াখালী জেলার মূল ভূ-খন্ড থেকে আলাদা রয়েছে অসংখ্য দ্বীপচর। জীবন-জীবিকার তাগিদে এসব এলাকার মানুষকে বাঁচার জন্য প্রতিনিয়তই প্রকৃতির বৈরীতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়। সাগরবক্ষের দ্বীপ সোনার চর, রূপার চর, চর তুফানিয়া, চর বাঁশবাড়িয়াসহ বহু সংরক্ষিত বনভূমির বেশির ভাগ গাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়ছে। মাটি ধুয়ে গাছের মূল বেরিয়ে যাওয়ায় শুকিয়ে মরে যাচ্ছে গাছপালা।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে এই অঞ্চলে খরা, অনাবৃষ্টিতে গাছপালা নষ্ট হচ্ছে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও অবাধে গাছ কাটার ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। এর কারণে বনাঞ্চলের মাটি ও কৃষি জমি ক্রমেই উর্বরতা হারাচ্ছে।
এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার পানি ও মাটিতে লবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পরিবেশ, বনাঞ্চল, জীববৈচিত্র্য ও কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাড়ছে সমুদ্রের পানির স্তর। কমে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের সমতল ভূমির উচ্চতা। তাই কৃষিনির্ভর এই অঞ্চলের মানুষ কৃষি উৎপাদন থেকে পিছিয়ে পড়ছে।