পরমাণু শক্তির ব্যবহার কৃষিতে

গামা রেডিয়েশন প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রম্নত পচনশীল বিভিন্ন ফল, ফুল ও সবজির সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণকালে পেঁয়াজ, রসুন ও আলুর গুণগতমান বজায় রেখে সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিসহ ওজন হ্রাসজনিত ক্ষতি কমিয়ে আনতে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে অনেকটা সফল হয়েছে। তাছাড়া, বিনা ভবিষ্যতের কৃষির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল স্বল্প জীবনকালের দানাদার, ডাল, তেলবীজ, সবজি, ফল, লেবু ও মসলা ফসলের জাত উদ্ভাবনে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী গবেষণা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে

প্রকাশ | ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

ড. মো: আব্দুল মালেক
জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের আওতায় বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবন করেছে আগাম, প্রতিকূলতা সহিষ্ণু ও বিভিন্ন ফসলের উচ্চফলনশীল নতুন নতুন জাত- যার ফলে, দেশের খাদ্য ও পুষ্ট নিরাপত্তা রাখছে বিশেষ ভূমিকা। বিশেষায়িত কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিনা'র উৎপত্তি দেশের কৃষি গবেষণায় পরমাণু শক্তি তথা পারমাণবিক কলাকৌশল প্রয়োগ ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশনের অধীনে পরমাণু শক্তি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র (অঊঅজঈ), ঢাকায় শুরু হয় এবং জুলাই ১৯৭২ সালে কেন্দ্রটি ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (ওঘঅ) হিসেবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (ইঅঊঈ) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮২ সালের ১ জুলাই ইঅঊঈ থেকে আলাদা হয়ে ওঘঅ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (ইওঘঅ) হিসেবে একটি স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পায়- যা ১৯৮৪ সালের অধ্যাদেশ নং-২ জারি করে প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করা হয়- যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) নামকরণ করা হয়। বিনা'র ভিশন হচ্ছে 'পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে উৎকর্ষতা সাধন' এবং মিশন হচ্ছে 'পরমাণু ও জীবপ্রযুক্তিসহ অন্যান্য আধুনিক কলাকৌশল ব্যবহার করে উচ্চফলনশীল ও প্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী ফসলের উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণ এবং কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন'। প্রধান কার্যালয়ের মোট ১১টি বিভাগসহ একটি আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্র এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৩টি উপকেন্দ্রের মাধ্যমে বিনা'র গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিনা'র ম্যান্ডেট হচ্ছে পারমাণবিক কলাকৌশল ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষণার মাধ্যমে আবহাওয়া ও পরিবেশ উপযোগী শস্যের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে টেকসই ও উৎপাদনশীল একটি কৃষি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; মাটি, ফসল ও পানির আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা; যথোপযুক্ত প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে শস্যের গুণগত মান উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং রোগ ও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ এবং ফসল ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির উন্নয়ন করা। কৃষিতে বিশেষ পারমাণবিক কৌশল তথা মিউটেশন প্রজনন পদ্ধতির মাধ্যমে ফসলের এমন সব কৌলিকতাত্বিক ভিন্নতা সৃষ্টি সম্ভব হচ্ছে পূর্বে যার অস্তিত্ব প্রকৃতিতে ছিল না। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে জেনেটিক গেইন বাড়াতে মিউটেশন প্রজনন বিশেষ ভূমিকা রাখছে এবং এ পদ্ধতিতে ফসলের জাত উদ্ভাবনে সময়ও লাগছে কম। বিভিন্ন ফসলের কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যের উন্নয়নে মিউটেশন প্রজনন পদ্ধতিই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মিউটেশন প্রজননকে কাজে লাগিয়ে জিনোম এডিটিং-এর মাধ্যমে জিনকে এডিট করে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যের জিন পাওয়াও সম্ভব হচ্ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি খরা, লবণাক্ততা, অসম বৃষ্টি, উচ্চ/নিম্ন তাপমাত্রা, আকস্মিক বন্যাজনিত কারণে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার এবং অন্যান্য আধুনিক গবেষণা কলাকৌশলের মাধ্যমে বিনা এ পর্যন্ত উদ্ভাবন করেছে ১৯টি ফসলের সর্বমোট ১২৮টি জাত, যার মধ্যে ৯৯টি জাত নিউক্লিয়ার কৌশল তথা মিউটেশন প্রজনন পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্ভাবিত। উদ্ভাবিত ফসলের জাতসমূহের মধ্যে রয়েছে দানাজাতীয় ফসলের ২৭, ডাল ফসলের ৪০, তেল ফসলের ৩৪, সবজি ফসলের ১৪, মসলা জাতীয় ফসলের ৬, পাটের ২, লেবুর ৩টি এবং ফলের ২টি জাত। বর্তমান সরকারের মেয়াদে বিগত সাড়ে ১৪ বছরে বিনা উদ্ভাবন করেছে ৮১টি উচ্চফলনশীল ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাত। উদ্ভাবিত জাতসমূহের বেশিরভাগই বৈরী আবহাওয়ার ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবিলায় অত্যন্ত উপযোগী ও স্থানীয় জাতের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ফলন দিচ্ছে। পারমাণবিক কৌশল তথা মিউটেশন প্রজনন পদ্ধতির মাধ্যমে বিনা উদ্ভাবিত জাতসমূহের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য জাতসমূহের দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কীভাবে অবদান রাখছে তা উলেস্নখ করা হলো : মঙ্গা নিরসনে আগাম জাতের আমন ধানের জাত উত্তরাঞ্চলের রংপুরসহ দেশের বেশ কিছু জেলায় কার্তিক মাসে কৃষকের হাতে না থাকতো কোনো কাজ এবং ঘরে থাকতো না গো-খাদ্যসহ নিজেদের প্রয়োজনীয় খাবার, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হতো মঙ্গা। এ মঙ্গা নিরসনে বিনা ২০০৭ সালে উদ্ভাবন করে উচ্চফলনশীল স্বল্প জীবনকালকালের বিনাধান-৭ (গড় ফলন ৪.৮ টন/হে.; জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন)- যা মধ্য আশ্বিন থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়। জাতটি অবমুক্ত হওয়ায় মঙ্গা এলাকার কৃষকরা বিনাধান-৭ আবাদের মাধ্যমে মঙ্গা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। ভবিষ্যতের মঙ্গা মোকাবিলায় বিনা পরবর্তী সময়ে আরও উদ্ভাবন করেছে ১২০-১২৫ দিনের জিংক সমৃদ্ধ বিনাধান-২০ (গড় ফলন ৪.৫ টন/হে.) ও ১১০-১২০ দিনের বিনাধান-২২ ও বিনা ধান২৬ (গড় ফলন ৬.০ ট/হে.)। উলিস্নখিত আমন ধানের জাতগুলোর সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা দূর হওয়ার পাশাপাশি ফসলের নিবিড়তা উলেস্নখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানিযোগ্য প্রিমিয়াম কোয়ালিটির সরু ও লম্বা চালের বোরো ধান বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করলেও রপ্তানিযোগ্য প্রিমিয়াম কোয়ালিটিসম্পন্ন সরু ও লম্বা চালের ধানের জাতের ছিল অভাব। বিনা সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভাবন করেছে প্রিমিয়াম কোয়ালিটিসম্পন্ন সরু ও লম্বা চালের বোরো ধানের জাত বিনা ধান২৫ (গড় ফলন ৭.৬ টন/হে.)। আশা করা যাচ্ছে, দেশের চাহিদা মিটিয়ে এ জাতের ধানের চাল বিদেশে রপ্তানি করাও সম্ভব হবে। স্বল্প জীবনকালের বোরো ধান দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য জোগানের জন্য ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমি হতে অধিক উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন উচ্চফলনশীলতার পাশাপাশি স্বল্প জীবনকালের বোরো ধানের জাত। বিনা উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকালের উচ্চফলনশীল বিনাধান-১৪, বিনাধান-২৪ ও বিনা ধান২৫ (গড় ফলন ৬.৫-৭.৬ টন/হে.)। আমন ধান পরবর্তী রবি ফসল সরিষা চাষ করে তারপর জাত তিনটি চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে, শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি করাও সম্ভব হচ্ছে। বন্যা পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন রোপা আমনধান লাগানোর সময় অর্থাৎ মধ্য জুলাই হতে আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার কারণে প্রায়ই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় সময়মতো চারা লাগানো সম্ভব হয় না। এ সমস্যা সমাধানে বিনা উদ্ভাবিত মিউটান্ট জাত বিনাশাইল নাবিতে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে রোপন করলেও তুলনামূলকভাবে কম সার প্রয়োগে হেক্টর প্রতি ৩.৫-৪.০ টন ফলন দেয়। লবণাক্ত এলাকার পতিত জমি চাষের আওতায় আনা বোরো মৌসুমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত অঞ্চল এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে লবণাক্ত সামুদ্রিক পানির অনুপ্রবেশ এবং ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানির কৈশিক প্রবাহের কারণে কৃষি জমিতে উচ্চ লবণাক্ততার কারণে ধান চাষ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। লবণাক্ত এলাকায় চাষোপযোগী মিউট্যান্ট জাত বিনাগম-১ (লবণাক্ত জমিতে গড় ফলন ২.৯ টন/হে.); বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনা সরিষা১২ (গড় ফলন ১.৪-১.৮ টন/হে.); বিনাচিনাবাদাম-৬, বিনাচিনাবাদাম-৭, বিনাচিনাবাদাম-৮, বিনাচিনাবাদাম-৯ (গড় ফলন ১.৮-১.৯ টন/হে.); বিনাতিল-২, বিনাতিল-৪ (গড় ফলন ১.১-১.২ টন/হে.); এবং বিনাসয়াবিন-৫, বিনাসয়াবিন-৬, বিনা সয়াবিন-৭ (গড় ফলন ১.৮-২.২ টন/হে.) উদ্ভাবনের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পতিত জমি চাষের আওতায় আনার পাশাপাশি ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিসহ কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটছে। ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিতে অবদান ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমি হতে উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রয়োজন একই জমিতে বছরে ২টির স্থলে ৩টি এবং ৩টির স্থলে ৪টি ফসল উৎপাদন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আমন ও বোরো ধানের চাষাধীন প্রায় ৭৫ শতাংশ ভাগ জমিতে বছরে ২টির স্থলে ৩টি ফসল চাষের আওতায় আনতে হলে আমন ও বোরো ধান চাষের মধ্যবর্তী সময়ে একটি রবি ফসলের অন্তর্ভুক্তির জন্য বিনা উদ্ভাবন করেছে উচ্চফলনশীল ও স্বল্প জীবনকালের আমনধান বিনাধান-৭, বিনাধান-২২ ও বিনাধান-২৬ (গড় ফলন ৪.৮-৬.১ টন/হে.); আমন ও বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে চাষোপযোগী উচ্চফলনশীল ও স্বল্প জীবনকালের জাত হচ্ছে বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১১ ও বিনা সরিষা-১২ (গড় ফলন ১.৬-২.০ টন/হে.); নাবিতে রোপনযোগ্য স্বল্প জীবনকালের বিনাধান-১৪, বিনাধান-২৪ ও বিনা ধান-২৫ (গড় ফলন ৬.৫-৭.৬ টন/হে.)। ফলশ্রম্নতিতে কৃষকরা সহজেই আগাম আমন ধান কর্তন করে স্বল্প জীবনকালের ও নাবিতে রোপনযোগ্য বোরো ধান চাষের পূর্বে সরিষা আবাদ করে সাময়িক পতিত জমি চাষের আওতায় আনছে। তাছাড়াও বিনা উদ্ভাবিত ফসলের জাত ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন কৃষি অঞ্চলে চার ফসল ভিত্তিক শস্য বিন্যাস উদ্ভাবনে বিনা নিবিড়ভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং অনেকক্ষেত্রেই সফলতা পেয়েছে। ফসলের খরা সহিষ্ণ জাত উদ্ভাবন সেচ সুবিধার বাইরে দেশের চরাঞ্চলে বিনাতিল-২ ও বিনাতিল-৪ (গড় ফলন ১.২-১.৩ টন/হে.) এবং বিনাচিনাবাদাম-৪, বিনাচিনাবাদাম-৬ ও বিনাচিনাবাদাম-৮ (গড় ফলন ২.৫-২.৯ টন/হে.) আশাতীত ফলন দিচ্ছে। খরা সহনশীল বিনাতিল-২ ও বিনাতিল-৪; বিনামুগ-৫, বিনামুগ-৭, বিনামুগ-৮, বিনামুগ-১১ ও বিনা মুগ-১২ (গড় ফলন ১.৮-২.০ টন/হে.); বিনাছোলা-৪, বিনাছোলা-৬, বিনাছোলা-১০ (গড় ফলন ১.৬-১.৮ টন/হে.); এবং বিনামসুর-৯, বিনামসুর-১০ ও বিনা মসুর১২ (গড় ফলন ১.৮-২.২ টন/ হে.) দেশের খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকায় চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষকগণ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ভোজ্যতেলে উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবদান দেশে প্রচলিত শস্য বিন্যাসে বিনা উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকালের উ"চফলনশীল ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু তেল ফসল বিশেষ করে সরিষার বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১১ ও বিনা সরিষা১২ (গড় ফলন ১.৬-২.০ টন/হে.), তিলের বিনাতিল-২ ও বিনাতিল-৪ (গড় ফলন ১.৪-১.৫ টন/হে.), সয়াবিনের বিনাসয়াবিন-৫, বিনাসয়াবিন-৬ ও বিনা সয়াবিন৭ (গড় ফলন ২.৫-২.৮ টন/হে.) এবং চীনাবাদামের বিনাচিনাবাদাম-৪, বিনাচিনাবাদাম-৬, বিনাচিনাবাদাম-৮, বিনাচিনাবাদাম-৯ ও বিনাচিনাবাদাম-১০ (গড় ফলন ২.৫-৩.০ টন/হে.) জাতসমূহ অন্তর্ভূক্ত করে সাময়িক পতিত জমি চাষের আওতায় আনাসহ ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বিশেষ করে চাষবিহীন এবং নাবিতে বপনযোগ্য সাময়িক জলাবদ্ধতা সহনশীল ও রোগ প্রতিরোধী বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯ ও বিনা সরিষা১২ দক্ষিণাঞ্চলের এক ফসলী নাবি আমনধান সংগ্রহের পর এবং হাওর অঞ্চলের বোরো ধান রোপনের পূর্বে চাষের জন্য খুবই উপযোগী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিনা উদ্ভাবিত তেলবীজ ফসলের উলিস্নখিত জাতগুলো সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক "তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প" এর মাধ্যমে প্রকল্প মেয়াদে (জুন ২০২৫ খ্রি. পর্যন্ত) ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০% দেশীয় উৎপাদন দিয়ে মিটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং ভবিষ্যতে আরো বেশি অবদান রাখবে। পুষ্টি নিরাপত্তায় ভূমিকা ২০১৪ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায় দেশের ৪১% শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও ৩৬ ভাগ শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম এবং এর মূল কারণ হিসেবে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পরিমিত আমিষ, চর্বি ও অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের ঘাটতিকে দায়ী করা হয়েছে। ধান ছাড়া ও তেলবীজ, ডাল, সবজি এবং মসলা ফসলের জাতগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয় হওয়ায় দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি পুষ্টি নিরাপত্তায় উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখছে বিনা। বিনা দেশের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক, জেলা, উপজেলা ও বস্নক পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিএডিসি'র কর্মকর্তা, এনএআরএস-ভূক্ত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী এবং বেসরকারি বীজ ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে মৌসুম ভিত্তিক ও ফসল ভিত্তিক আঞ্চলিক ও জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করছে। এছাড়াও বিনা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদেরকে উদ্ভাবিত সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে। উদ্ভাবিত সম্ভাবনাময় জাত ও প্রযুক্তিসমূহ কৃষক পর্যায়ে দ্রম্নত সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে মাঠদিবসের আয়োজনসহ কৃষক উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির আয়োজন করে আসছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বিষয়ে বিনা নিয়মিতভাবে কৃষি প্রযুক্তি হাতবই, ফ্যাক্টশিট ও লিফলেট সম্প্রসারণকর্মীসহ কৃষকদের মাঝে বিতরণ করছে, ফলে বিনা উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহ কৃষক পর্যায়ে দ্রম্নত সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে অবদান রাখছে। গামা রেডিয়েশন প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রম্নত পচনশীল বিভিন্ন ফল, ফুল ও সবজির সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণকালে পেঁয়াজ, রসুন ও আলুর গুণগতমান বজায় রেখে সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিসহ ওজন হ্রাসজনিত ক্ষতি কমিয়ে আনতে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে অনেকটা সফল হয়েছে। তাছাড়া, বিনা ভবিষ্যতের কৃষির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল স্বল্প জীবনকালের দানাদার, ডাল, তেলবীজ, সবজি, ফল, লেবু ও মসলা ফসলের জাত উদ্ভাবনে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী গবেষণা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। একই সাথে অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার ইরুসিক এসিড সমৃদ্ধ সরিষার উ"চফলনশীল জাত এবং চরাঞ্চলে চাষ উপযোগী স্বল্প জীবনকালের চিনাবাদাম, তিল, সয়াবিন, চীনা, কাউন এবং দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণে সূর্যমুখীর উ"চফলনশীল ও খাটো জাত, ধানের উ"চফলনশীল, উন্নত গুণাগূনসম্পন্ন, প্রতিকূলতা সহমশীল ও স্বল্প জীবনকালের জাত, উ"চফলনশীল ও উন্নত গুণাগুণসম্পন্ন ডাল ফসল এবং পাটের জাতসহ উদ্যানতাত্বিক বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।