ড্রোন পাল্টে দিচ্ছে বিশ্ব পরিস্থিতি

ড্রোনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ফলে ড্রোনগুলো হয়ে উঠছে আরও ভয়ঙ্কর। একেবারে নিখুঁতভাবে শত্রম্নপক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানছে। তাও আবার রাডারের চোখ ফাঁকি দিয়ে। আমরা জানি, রাডার ফাঁকি দেওয়া সহজ কথা না। কিন্তু ড্রোন সেটা করছে। এছাড়া ড্রোন যদি ধ্বংসও করে ফেলে যা প্রচুর ঘটছে সেটিও খুব বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে না। কারণ ড্রোন তৈরির খরচ তুলনামূলক কম। অন্যান্য অস্ত্রের তুলনায় তো কমই। বিপরীতে নিরাপদ স্থানে বসেই এসব ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করা যায় অনায়াসে। নিজেদের প্রাণহানি ঘটনার সম্ভাবনা থাকে না। এটি যুদ্ধক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দিতে সক্ষম। এক সময় ড্রোনগুলো শুধু গোয়েন্দা কার্যকম পরিচালনায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। এখন সেসবের পাশাপাশি হামলার কাজেই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।

প্রকাশ | ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

অলোক আচার্য
সমরাস্ত্র বরাবরই আধুনিকায়ন এবং প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়ে তৈরি হচ্ছে। মূলত পরাশক্তিগুলো এমন অস্ত্রের দিকে ঝুঁকছে যে অস্ত্রগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগত সুবিধা দিতে সক্ষম। শত্রম্নর চোখ ফাঁকি দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিখুঁত নিশানায় আঘাত করতে সক্ষম যে অস্ত্র সেগুলোই মূলত পরাশক্তিগুলোর নজরে। যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন মাত্রা আনতে যাচ্ছে ড্রোন প্রযুক্তি। বদলে যাচ্ছে প্রচলিত যুদ্ধব্যবস্থা। সর্বশেষ কয়েকটি যুদ্ধে ড্রোনের অতি উচ্চমাত্রার সফলতার কারণে সব দেশই তাদের সমরনীতি ও সমর কৌশলে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হচ্ছে। নৌ, বিমান আর স্থলবাহিনীর সঙ্গে সমন্বিত বা অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে যাচ্ছে ড্রোন প্রযুক্তি। পাল্টে যেতে পারে আগামী দিনের যুদ্ধের সব হিসাব-নিকাশ। ড্রোন প্রযুক্তির দ্রম্নত উন্নতির কারণে সামরিক দিক দিয়ে পেছনে থাকা অনেক দেশ ওপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। পরাশক্তি দেশের মধ্যে দ্রম্নত ব্যবধান কমিয়ে আনতে যাচ্ছে ড্রোন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান উলেস্নখযোগ্য। ইরান ড্রোন ব্যবস্থা অনেক আধুনিক এবং নির্ভর করতে পেরেছে। ইরানের ড্রোন এখন সারা বিশ্ব টেক্কা দিচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখছে এসব ড্রোন। সম্প্র্রতি ইরানের সেনাবাহিনীর উচ্চপ্রশিক্ষিত ও অভিজাত দল বিপস্নবী রক্ষীবাহিনী (আইআরজিসি) এক হাজার নতুন ড্রোন হাতে পেয়েছে। জানা গেছে, 'ড্রোনগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে, দুই হাজারেরও বেশি পালস্না, উচ্চ পর্যায়ের ধ্বংসাত্মক সক্ষমতা, রাডার ফাঁকি দিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করা এবং নিজে উড়ে গিয়ে লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারার সক্ষমতা। এখন প্রশ্ন হলো কেন ক্রমেই পরাশক্তিগুলোর কাছে ড্রোনের কদর বাড়ছে। এর কারণ হলো কৌশলগতভাবে ড্রোন খুব কার্যকর। টার্গেট কিলিং বা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে ড্রোনের সফলতা সবচেয়ে বেশি সাম্প্র্রতিককালে। বর্তমানে যুদ্ধরত দেশগুলো এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে। ভবিষ্যতেও যে এই ব্যবহার অব্যাহত থাকবে সেটি বলাই যায়। এরপর আবার ড্রোনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ফলে ড্রোনগুলো হয়ে উঠছে আরও ভয়ঙ্কর। একেবারে নিখুঁতভাবে শত্রম্নপক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানছে। তাও আবার রাডারের চোখ ফাঁকি দিয়ে। আমরা জানি, রাডার ফাঁকি দেওয়া সহজ কথা না। কিন্তু ড্রোন সেটা করছে। এছাড়া ড্রোন যদি ধ্বংসও করে ফেলে যা প্রচুর ঘটছে সেটিও খুব বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে না। কারণ ড্রোন তৈরির খরচ তুলনামূলক কম। অন্যান্য অস্ত্রের তুলনায় তো কমই। বিপরীতে নিরাপদ স্থানে বসেই এসব ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করা যায় অনায়াসে। নিজেদের প্রাণহানি ঘটনার সম্ভাবনা থাকে না। সম্প্র্রতি মিয়ানমারের জান্তা সরকার বিদ্রোহীদের দমনে ব্যাপক ড্রোন ব্যবহার করছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এটি যুদ্ধক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দিতে সক্ষম। এক সময় ড্রোনগুলো শুধু গোয়েন্দা কার্যকম পরিচালনায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। এখন সেসবের পাশাপাশি হামলার কাজেই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। গত বছরের খবর অনুযায়ী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রুশবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে 'ড্রাগন ড্রোন' ব্যবহার শুরু করার খবর পাওয়া গেছে। এ ড্রোনে ব্যবহার করা হয় অ্যালুমিনিয়াম গুঁড়া ও আয়রন অক্সাইডের উত্তপ্ত মিশ্রণ, যা থার্মাইট নামে পরিচিত। এটি ৪ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট (২ হাজার ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় পুড়তে থাকে। নানা ধরনের, নানান ডিজাইনের ও সক্ষমতার ছোট-বড় এসব ড্রোন আজ বহুল ব্যবহৃত। মনুষ্যহীন আকাশযান (ইউএভি বা ড্রোন) অনেক দশক ধরেই যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নও গোয়েন্দা নজরদারির কাজে করেছে ড্রোনের ব্যবহার, বিশেষত ভিয়েতনাম যুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এটি। তবে কয়েক দশক আগে ড্রোনকে বহুদূরের লক্ষ্যে আঘাত হানতে ব্যবহার শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। যুগের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে প্রযুক্তি। ড্রোনের আকারেও এসেছে পরিবর্তন। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে বড় আকারের রিপার ড্রোন ব্যবহার করেছে। প্রায় ৩ কোটি ডলার দামের এই ড্রোনগুলোকে বহু দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করতেন এর পাইলটরা। ড্রোন আসলে কী? এক সময় মানুষ অনুভব করে যে, তার নিরাপত্তার কারণে এমন বিমান দরকার, যা নিজে নিজেই পরিচালিত হবে বা দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। সেখান থেকেই আসে চালকবিহীন উড়োজাহাজের কথা। ড্রোন হচ্ছে এমন এক ধরনের উড়োজাহাজ মানে বিমান, যা পাইলট বাদে চলাচল করে। আভিধানিক অর্থ হচ্ছে গুঞ্জন। কারণ এটি যখন চলে এটা মৌমাছির গুনগুনের মতো শব্দ করে প্রথম পাইলটবিহীন বিমান প্রথম- বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিকশিত হয়েছিল। ব্রিটেনের 'এরিয়াল টার্গেট' একটি ছোট রেডিও-নিয়ন্ত্রিত বিমান, ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে প্রথম পরীক্ষা করা হয়েছিল। আমেরিকার তৈরি টর্পেডো প্রথম ১৯১৮ সালের অক্টোবরে উড়েছিল। সর্বপ্রথম ভিয়েতনাম যুদ্ধে বৃহৎ আকারে ড্রোন মোতায়েন করা হয়েছে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ড্রোনের ব্যাবহার শুরু হয়েছে। জরুরি ওষুধ-ইঞ্জেকশন এবং টিকা ডেলিভারি দেওয়া যাচ্ছে খুব সহজে। কৃষিক্ষেত্রেও ড্রোনের ব্যবহার হচ্ছে সফলভাবে। বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে এখন ড্রোনের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করা হয়। বাণিজ্যিক কারখানা, পাহাড়ি রাস্তাঘাট, ব্রিজ এবং বাঁধ এগুলো তৈরি করার পূর্বে ড্রোন উড়িয়ে সম্পূর্ণ পস্নট-এর ম্যাপিং খুব সহজে করা যায়। এসব ছাপিয়ে ড্রোনের সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহারই সর্বাধিক আলোচনায় রয়েছে এর সফলতার কারণে। অস্ত্র মানেই বিপুল ব্যবসা। একদিকে ধ্বংস আবার অন্যদিকে ফুলে ফেঁপে ওঠা। আবার শক্তিমত্তার নির্ণায়কও এই অস্ত্র। এই বিশ্ব চলছে অস্ত্রের দাপটে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমরনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করেছে। জোট এবং জোটনীতিতেও নতুন চিন্তা-ভাবনা যোগ হচ্ছে। সেই সঙ্গে বর্তমান পৃথিবীর শক্তিমত্তার অন্যতম নির্ধারক অস্ত্র সমৃদ্ধকরণেও গতি সঞ্চার করেছে। সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে নিরাপত্তা জোরদার করার চেষ্টা করছে। জোর দিচ্ছে জোটের ওপর এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর। সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নয়, বরং এখন যেন এটাই করতে হচ্ছে। ড্রোনের ক্ষেত্রে সামরিক ড্রোনের একটি বড় অংশই রয়েছে তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে। বর্তমানে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ও দ্রম্নত উৎপাদন সক্ষমতাসম্পন্ন ড্রোন নির্মাতা হিসেবে পরিচিত তারা। এই বাজারের প্রায় ৬০ শতাংশই এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে বায়কার নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধের উপযোগিতার জন্য তাদের সশস্ত্র ড্রোনগুলো খুবই জনপ্রিয়। তুরস্কের প্রতিরক্ষা ও উড্ডয়ন খাতে নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে বায়কার। বর্তমানে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ও দ্রম্নত উৎপাদন সক্ষমতা সম্পন্ন ড্রোন নির্মাতা হিসেবে পরিচিত তারা। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী রাশিয়ার বিরুদ্ধে বায়রাকতার টিবিটু ড্রোন ব্যবহার করার পর এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পায়। পাশাপাশি, আজারবাইজান ও উত্তর আফ্রিকার যুদ্ধেও এই ড্রোন ব্যবহার হয়। দেশটির শীর্ষ প্রতিরক্ষা উপকরণ রপ্তানিকারক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে বায়কার। ৫৫০ কোটি ডলারের এই খাতের এক তৃতীয়াংশই আসে বায়কারের মাধ্যমে। যদি কোনো দেশ কোনো শক্তিশালী দেশ দ্বার আক্রান্ত হয় তখন অস্ত্রই হবে তা প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। ফলে বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে সামরিক খাতে। অথচ মানবিক দিক যেমন সবার জন্য খাদ্য নিশ্চয়তা, শিক্ষা বা চিকিৎসার মতো অতি মৌলিক এবং জরুরি বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিটি দেশেরই বহিঃশত্রম্নর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার থেকেই নিজেকে সুরক্ষার প্রচেষ্টা করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বাগদাদ বিমানবন্দরের বাইরে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যায় রিপার ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। আমেরিকা এবং ইসরায়েল ছাড়াও আরও অনেক দেশ সামরিক ড্রোন ব্যবহার শুরু করেছে। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানসহ বিভিন্ন যুদ্ধে এখন মানববিহীন ড্রোন ব্যবহার অপরিহায্য হয়ে উঠেছে। বর্তমানে একশ'টিরও বেশি দেশ এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছে এ যন্ত্র রয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে ড্রোন আরও আধুনিক হয়ে সমর বিশ্বে রাজত্ব করবে এটুকু নিশ্চিত।