চীন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার প্রতিযোগিতা আধুনিক পৃথিবীর এক নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কোন ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা নেই? অর্থনীতি, সমরনীতি, রাজনীতি এবং প্রযুক্তি- সব ক্ষেত্রেই রয়েছে তুমুল প্রতিযোগিতা। চীন চাইছে পরাশিক্তর কাতারে প্রথমে আসতে আর যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বহু বছরের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে। এরই একটি উদাহরণ হতে পারে ডিপফেক এবং ডিপসেক। বর্তমান সময়ের একটি অস্বস্তির নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিপফেক প্রযুক্তি। এ যেন মানুষের স্বাভাবিক জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ডিপফেক প্রযুক্তি নিয়ে যখন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীকে টেক্কা দিচ্ছে তখন চীনের ডিপসিক প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে যেমন আমেরিকা উদ্বিগ্ন, একই সঙ্গে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এ খাতে চীনের অগ্রগতিকে যতটা সম্ভব দমিয়ে রাখতে। অল্প সময়ের মধ্যেই এটি অ্যাপলের 'অ্যাপ স্টোর'-এ সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া ফ্রি অ্যাপ হিসেবে তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছে। উদ্ভাবন করেছেন ৩৯ বছর বয়সি চীনা প্রযুক্তিবিদ লিয়াং ওয়েনফেং। এটির নির্মাণ ব্যয় মাত্র ৬০ লাখ ডলার। চীনের প্রতিযোগী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিপসিক ডাউনলোড করা শুরুতেই রেকর্ড পরিমাণ। এ নিয়ে অর্থবাজারও ধাক্কা খেয়েছে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে এটি জনপ্রিয়তায় ছাড়িয়ে গেছে ডিপফেককে। এটি যেমন দামে কম তেমনি অধিক কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। 'ডিপসিক-আর ওয়ান' নামে স্বল্প পরিচিত এই চীনা স্টার্টআপ অ্যাপ গুগল ও ওপেনএআইয়ের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এনভিডিএ উচ্চমানের চিপের প্রয়োজন কমিয়ে দিয়ে ডিপসিক প্রমাণ করেছে, বড় বাজেট বা শীর্ষ মানের চিপ ছাড়াও এআই খাতে সাফল্য আনা সম্ভব। বিশ্লেষকদের মতে, ডিপসিকের সাফল্য এআই প্রযুক্তি এবং বাজারে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ডিপসিক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চিন্তিত না হলেও চীন যে যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিচ্ছে সেটি অস্বীকার করা যায় না। যদিও ডিপফেক বা ডিপসিকের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাগুলো এখন মানুষ ব্যাপকভাবে সাইবার বুলিং এবং সাইবার অপরাধের মতো কাজের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে এবং এর কারণে অনেক দেশেই নিষিদ্ধ করছে বা নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে।
দেশে দেশে বিধিনিষেধের কবলে পড়েছে সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা চীনা এআই প্রতিষ্ঠান ডিপসিক। নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ান এরই মধ্যে ডিপিসিকের এআই ব্যবহার সীমিত বা নিষিদ্ধ করেছে। অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, চীনা প্রতিষ্ঠানটি 'অগ্রহণযোগ্য নিরাপত্তা ঝুঁঁকি' তৈরি করছে। তাদের মতে, ডিপসিকের 'ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ' এবং 'বিদেশি সরকারের নির্দেশে তথ্য ব্যবহারের আশঙ্কা' অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রতিযোগিতামূলক এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প সেটি বলেছেনও। এটি যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য দেশকেও কম খরচে প্রযুক্তির উদ্ভাবনে উৎসাহিত করবে। এটি হবে প্রতিযোগিতামূলক এবং এর ফলে প্রযুক্তি আরও সহজলভ্য এবং কম খরচের হবে। মানুষের জীবনযাত্রা সবচেয়ে সহজ, সাবলীল এবং তাৎপর্যপূর্ণ করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। সেটা আর একটু সহজ করতেই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও মানুষের জীবনকে এমনকি মানবসভ্যতাকে চরম বিরক্তিকর ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছেও এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। এই ডিপফেক বা ডিপসিক যাই হোক না কেন এসব কিন্তু ব্যবহারের শুরু থেকেই সমালোচিত। প্রযুক্তিতেই উত্থান ও প্রযুক্তিতেই সর্বনাশ। চারদিকে এখন এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়জয়কার। এসবের প্রতিযোগিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোটামুটি একক আধিপত্য রয়েছে। সেখানে এখন চীন পৌঁছে গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শুল্ক আরোপের যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে সেই তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছে চীন। সেই প্রতিযোগিতার আঁচ পাওয়া যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও। বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন সেই দৌড়ে খানিকটা যুক্তরাষ্ট্রকে পিছনে ফেলেছে। নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী কৌশল মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা আরও তীব্র করে তুলবে। ডিপসিকের উত্থান এআই খাতের জন্য নতুন একটি মাইলফলক।
সেই অতীতকাল থেকেই কারও বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত কুৎসা রটানো, মিথ্যা প্রচার করা এবং কাউকে হেয় করার প্রবণতা মানুষের মাঝে ছিল এবং এখনো আছে। শুধু সময়ের পরিবর্তনের ফলে মাধ্যমের পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্বজুড়েই মাত্র কিছুদিন আগেও একটি আতঙ্কের নাম এই ডিপফেক। এখন হয়তো এর সঙ্গে ডিপসিক নামটি যোগ হবে। ইদানীংকালে অর্থাৎ এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জয়জয়কারের যুগে যে বিষয়টি প্রায় প্রতিনিয়তই আলোচিত হচ্ছে সেটি ডিপফেক শব্দ। এই ডিপফেকের কবলে পরে নামিদামি তারকারা, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সবাই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নারীরা এ প্রযুক্তির শিকার হচ্ছেন বেশি। নারীদের মুখের ছবি নিয়ে বানানো হচ্ছে অ্যাডাল্ট ভিডিও এবং তা অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন এক অবস্থা যে এক মুহূর্তেই আপনি হিরো থেকে তলানিতে ঠেকছেন। অথচ সেটি আপনি আদৌ সেই ভিডিওর বিষয়ে কিছুই জানেন না। এটা ঘটানো হচ্ছে এআই অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে। একটি পুরোপুরি মিথ্যা ঘটনাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়িয়ে ব্যক্তির সুনাম ক্ষণ্ন্ন করাই হলো ডিপফেক। ডিপফেক হলো এমন একটি প্রোগ্রাম যা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের একটি ধরন 'ডিপ লার্নিং টেকনোলজি' ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। মূলত এই পদ্ধতিতে অডিও, ভিডিও এবং ছবিতে কারসাজি করে এমন কনটেন্ট বানানো হয়, যা দেখে আসল কি নকল তা বোঝার উপায় থাকে না। ডিপফেক টেকনোলজি সর্বপ্রথম ২০১৭ সালে প্রচারণা পায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে অত্যন্ত বাস্তব, কিন্তু ভুয়া ছবি, অডিও, ভিডিও এবং অন্য ধরনের জালিয়াতির মধ্য দিয়ে। মেশিন লার্নিং প্রয়োগের মাধ্যমে দিন দিন প্রযুক্তিটি আরও উন্নত হচ্ছে এবং নিখুঁতভাবে নকল ভিডিও বানানো হচ্ছে। এতটাই নিখুঁত যে এটি প্রমাণ করা বেশ কষ্টসাধ্য যে, ভিডিওটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বানানো হয়েছে। খালি চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই এটি নকল। কিন্তু আসলে এটি একটি মিথ্যা ভিডিও। কারণ এখানে ঠোঁটের নড়াচড়া থেকে শুরু করে সব অঙ্গভঙ্গি এবং মানুষের ছায়ারও নকল করা হয়। বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে কঠোর অবস্থানে গেছে। বেশিরভাগ ডিপফেক ভিডিও এবহবৎধঃরাব অফাবৎংধৎরধষ ঘবঃড়িৎশ (এঅঘং)-এর মাধ্যমে বানানো হয়। যেটির মধ্যে দু'টি গধপযরহব ষবধৎহরহম সড়ফবষ কাজ করে। যাই হোক, ডিপফেক বা ডিপসিক যেটাই হোক না কেন এটি কেবল ভালো কাজের উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে না।
আর দশটা প্রযুক্তির মতোই এটাও নেতিবাচক ব্যবহার হবে। তবে এখানে উলেস্নখ্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে পরাশক্তি হয়ে ওঠা এবং প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা এগিয়ে যায়। সেটাও আবার প্রযুক্তিতে। ১৯৫৫ সালে চার দিনের ব্যবধানে দুই দেশই ঘোষণা দেয়, তারা মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করবে। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও বাকি বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথে জায়গা করে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়নের কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১। শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রথম নভোচারীকে চাঁদে পাঠায় তখন চোখ কপালে উঠে যায় বিশ্ববাসীর। রাশিয়ারও। সেই থেকে প্রতিযোগিতা চলছে। মহাকাশ, মহাবিশ্ব, গ্রহ দখল, গবেষণা, বোমা তৈরি, রোবটিক ক্ষেত্র এবং সর্বশেষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। শুধু এই দশকে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চীন। মূলত প্রধান প্রতিযোগিতাটাই হচ্ছে চীনের সঙ্গে। প্রযুক্তি যত সহজলভ্য হবে, তত বেশি মানুষ এটি ব্যবহার করবে। মূলত এর ব্যবহার পদ্ধতি, মূল্য এবং সহজলভ্যতা ও নিশ্চয়তা এসবের ওপর ভিত্তি করেই কোনো পণ্য মানুষের ব্যবহারের নাগালে আসে এবং ব্যবহার করে। ডিপসিক এখন ডিপফেককে পালস্না দিয়ে এগিয়ে গেছে। দেখার বিষয় এই নতুন প্রযুক্তি আবার দুই দেশের প্রযুক্তি যুদ্ধ শুরু করে কি না।