প্রথম বাঘের গর্জন শুনেছিল বিশ্ব

প্রকাশ | ০১ জুন ২০২০, ০০:০০

ক্রীড়া ডেস্ক
১৯৯৯ সালের ৩১ মে বিশ্বকাপের ম্যাচে পাকিস্তানকে হারানোর পর বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়-কর্মকর্তা-সমর্থকদের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস -ফাইল ফটো
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। ক্রিকেটপাগল এই দেশটি টেস্ট স্ট্যাটাস পায় ২০০০ সালে। ক্রিকেটের কুলীন গোত্রের সদস্য হওয়ার পর বড় একটা সময় মিনোজ হিসেবে পরিচিত ছিল বাংলাদেশ দল। মাঝে মাঝে জয় পেলেও ২০১৫ সালের আগে কখনোই সেভাবে সমীহ করার মতো দল হয়ে ওঠেনি টাইগাররা। স্বাভাবিকভাবেই টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আগে বাংলাদেশকে সেভাবে কেউ গোনায় ধরেনি। তার ওপর ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে টাইগাররা। ফলে বড় দলগুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশের অসহায় আত্মসমর্পণের দৃশ্যই সবার কাছে স্বাভাবিক ছিল। তবে এই বিশ্বকাপেই একটি ম্যাচে বড় অঘটন ঘটিয়ে ফেলে লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। বলা যায় এই ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো বিশ্বমঞ্চে নিজেদের নতুন করে চেনায় বাংলাদেশ। আজ থেকে ঠিক ২১ বছর আগে ১৯৯৯ সালের ৩১ মে হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ, যার পর সেই বিশ্বকাপে খেলা টাইগার ক্রিকেটাররা হয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় তারকা। আলোচ্য বিশ্বকাপে নিজেদের শেষ ম্যাচে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। দুই দলের কারোরই এই ম্যাচ থেকে প্রমাণ করার কিছু ছিল না। বলতে গেলে উভয় দলের জন্য এটি ছিল নিয়ম রক্ষার একটি ম্যাচ। গ্রম্নপপর্বের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হওয়ার আগে পাকিস্তান ছিল টেবিল টপার। তাই প্রথমবার আসা বাংলাদেশকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি তারা। টস জিতে বাংলাদেশকে আগে ব্যাট করতে পাঠায় পাকিস্তানের অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম। উদ্দেশ্য খুবই সহজ, দ্রম্নত অল আউট করে তাড়াতাড়ি রান তাড়া করে আগেভাগে ম্যাচটা শেষ করা। যেহেতু সুপার সিক্স এরইমধ্যে নিশ্চিত তাই পুঁচকে বাংলাদেশের সঙ্গে বেশি সময় নষ্ট করতে চাননি তিনি। বাংলাদেশের হয়ে ইনিংস উদ্বোধন করতে নামেন শাহরিয়ার হোসেন বিদু্যৎ ও মেহরাব হোসেন অপি। ওয়াকার ইউনিসের করা ইনিংসের প্রথম ওভারটি দেখেশুনে খেলে মেইডেন দেন বিদু্যৎ। রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেসখ্যাত শোয়েব আখতারের করা পরের ওভার থেকে ২ রান নেন অপি। তৃতীয় ওভারের তৃতীয় ও পঞ্চম বলে দুটি চার মারার পর খোলসে ঢুকে যান বাংলাদেশি দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান। একেরপর এক সিঙ্গেল নিয়ে ইনিংস এগিয়ে নিতে থাকেন তারা। প্রথম ১০ ওভার শেষে কোনো উইকেট না হারিয়ে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ৩১ রান। এই দু'জনের বিদায়ের পর নাইমুর রহমান দুর্জয় ও আকরাম খান মিলে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন। ব্যাটসম্যানদের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে এক পর্যায়ে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ৫ উইকেট হারিয়ে ১৫০ রান। এমতাবস্থায় মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও মাহমুদের দুটি ছোট্ট তবে কার্যকরী ক্যামিওর সৌজন্যে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৯ উইকেট হারিয়ে ২২৩ রান করে টাইগাররা। পাকিস্তানের সাকলাইন মুশতাক ৩৫ রানে শিকার করেন ৫ উইকেট। সাঈদ আনোয়ার ও শহিদ আফ্রিদি পাকিস্তানের ইনিংস উদ্বোধন করতে নামেন। বাংলাদেশের পক্ষে বোলিং আক্রমণের সূচনা করেন খালেদ মাহমুদ সুজন। দলের হয়ে প্রথম আঘাত হানেন তিনিই। মাত্র ৭ রানে ২ উইকেট হারায় পাকিস্তান। তখনই মনে হয়, আজ কি কিছু হতে যাচ্ছে? এমতাবস্থায় প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানকে আরও চেপে ধরা। টাইগার অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল করলেনও তাই। অষ্টম ওভারে আসে তৃতীয় সাফল্য। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের মেরুদন্ড বলে পরিচিত সাইদ আনোয়ারকে রানআউট করেন খালেদ মাসুদ পাইলট। তাদের সংগ্রহ তখন ২৬/৩। ইনজামাম উল হক ও সেলিম মালিক আউট হলে পাকিস্তানের স্কোর বোর্ডের চেহারা দাঁড়ায় ৫ উইকেটে মাত্র ৪২ রান। ষষ্ঠ উইকেটে যোগ করেন মোট ৫৫ রান। মঈন খান যখন আউট হন তখন পাকিস্তানের প্রয়োজন আরও ১০৪ রান। ম্যাচ বলতে গেলে বাংলাদেশের হাতের মুঠোয়। তবে সাকলাইন মুশতাক ও ওয়াকার ইউনিস এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন। দেখেশুনে ৮টি ওভার পার করেন দু'জন। ৪৩ ওভারে নবম উইকেটের পতনের পর শুরু হয় মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা। শেষ পর্যন্ত ৪৫তম ওভারে আসে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। দুর্জয়ের বল ড্রাইভ করে শোয়েব আখতার ওপারে পৌঁছলেও সময়মতো ক্রিজে পৌঁছতে পারলেন না সাকলাইন। খালেদ মাসুদ পাইলট স্ট্যাম্প ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে যেন ভেঙ্গে দিলেন পাকিস্তানের দর্প। তাদেরকে ১৬১ রানে অল আউট করে দিয়ে ৬২ রানের বড় ব্যবধানে জিতে যায় বাংলাদেশ। একইসঙ্গে বাঁধভাঙা আনন্দে মাতেন দেশবাসী। এই জয়ে প্রথমবারের মতো কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশকে একদিনের ম্যাচে ধরাশায়ী করে বাংলাদেশ। অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ম্যাচ সেরার খেতাব জিতে নেন খালেদ মাহমুদ সুজন। সে সময়ের মহাপরাক্রমশালী পাকিস্তানকে রীতিমতো তুলোধুনো করে হারানো ম্যাচটি পরবর্তীতে বাংলাদেশকে টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল বলে মনে করেন অনেক ক্রিকেটবোদ্ধা। অবিস্মরণীয় এই ম্যাচটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সেরা ম্যাচ। ২১ বছর আগের আজকের এই দিনেই রচিত হয়েছিল অমর সেই কীর্তিগাথা।