বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ই-কমার্স: আইন নেই মানছে না নীতিমালাও

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

সুই থেকে গাড়ি এখন অনলাইনে মেলে। কল বা ম্যাসেজে পণ্য পৌঁছে যায় ভোক্তার দোরগোড়ায়। করোনা মহামারিতে দেশে অনলাইনে কেনাকাটার প্রবণতা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে এ নিয়ে সমস্যাও। ছবির সঙ্গে পণ্যের অমিলের অভিযোগ যেমন করছেন ভোক্তারা, তেমনি অভিযোগ রয়েছে সঠিক সময়ে ডেলিভারি না হওয়া নিয়েও। এছাড়া মানহীন পণ্য কিংবা টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহ না করার মতো গুরুতর অভিযোগ কম নয়।

দেশে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণে কোনো আইন না থাকায় এসব অভিযোগের কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না ভোক্তারা। এ সুযোগে বাজার ধরতে বেপরোয়া কৌশলও অবলম্বন করছে অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান, যা খাতটিকে বিশৃঙ্খল করে তুলছে। সব মিলিয়ে আস্থার সংকট নিয়ে বড় হচ্ছে অনলাইন ব্যবসা।

প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, আর সঠিক নীতি- এ দুটিই ছিল চীনে ই-কমার্সের উন্নতির মূল চাবিকাঠি। ফলে শুরুতে নকল পণ্য কিংবা গ্রাহকদের ঠকানোর মতো ঘটনা ঘটলেও এখন ই-কমার্সে বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে দেশটি। চীনে প্রতি বছর ৩৫ শতাংশ হারে প্রসারিত হচ্ছে ই-কমার্স খাত, যা দেশটিকে বিশ্বের অন্যতম দ্রম্নত বর্ধনশীল ই-কমার্স বাজারে পরিণত করেছে। দেশটিতে প্রতি বছর অনলাইনে ৬৭২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কেনাবেচা হয়। চীনের খুচরা বাজারের ১৫ দশমিক ৯ শতাংশই এখন ই-কমার্সের দখলে। চীনা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলীবাবা গ্রম্নপের আলীবাবা, টাওবাও, টিমল বিশ্ববাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও শীর্ষে রয়েছে। বিশ্ববাজারে বেশ ভালো অবস্থানে আছে চীনের আরেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান জে ডি ডটকম।

ভোক্তা সুরক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার উপযোগী নীতিমালা রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। সম্প্রতি দেশটিতে নতুন করে ই-কমার্স নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা, গ্রাহকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা থাকছে। এসব কারণে ভারত ই-কমার্স খাতের বড় খেলোয়াড় হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফ্লিপকার্ট, স্ন্যাপডিলের ভারতীয় ই-কমার্সগুলো স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে বিশ্ববাজারেও বেশ পরিচিতি পেয়েছে।

অন্যদিকে দ্রম্নত বড় হওয়ার পর্যায়ে থাকলেও দেশে ই-কমার্স নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আইন করা হয়নি। ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা নামে একটি নীতিমালা থাকলেও সেটা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। দেশে ভোক্তা অধিকার আইন থাকলেও সেটা কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের আইন না হওয়ায় এটি দিয়ে ই-কমার্স খাত নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মূলত আইনটি কাজে লাগে ভোক্তার প্রতারিত হওয়া ঠেকাতে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ই-কমার্স সম্পর্কিত আইন না থাকার কারণে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান প্রিয়শপ ডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশিকুল আলম খান বলেন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার নীতিমালার নিয়মগুলো এখনো ই-কমার্স খাতের উপযোগী নয়। আমার মনে হয়, ভোক্তা অধিকার নীতিমালায় কিছুটা পরিবর্তন করে ই-কমার্স উপযোগী করে তোলা উচিত। এতে ই-কমার্স খাতের উপকার হবে।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) হিসাবে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজারের আকার ছিল মাত্র ৪৫০ কোটি টাকার। বর্তমানে এটি সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত বছর অনলাইনে লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বছর ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন ই-কমার্স খাতের ব্যবসায়ীদের এ সংগঠনটির নেতারা।

অন্যদিকে ই-ক্যাবের হিসাবের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না খাতটিরই অনেক ব্যবসায়ী। তারা বলছেন, ই-কমার্সের বাজারের আকার নিয়ে কিছুটা অতিরঞ্জিত তথ্য দেওয়া হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান মানেই তাদের অনেক আয়, তাদের অনেক টাকা। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটি পুরোপুরি ভিন্ন। লাভজনক জায়গায় চলে গেছে এমন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাংলাদেশে হাতে গোনা বলে জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি তারা বলছেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এখনো বাজার তৈরির পর্যায়েই রয়েছে। এজন্য একেক প্রতিষ্ঠান একেক ধরনের বিপণন কৌশল অবলম্বন করছে। ছাড়, অফার, ক্যাশব্যাক ফ্রি ডেলিভারিসহ নানা পন্থা অবলম্বন করছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিংবা ভোক্তা কারো জন্যই এখন পর্যন্ত যুগোপযোগী কোনো আইনি কাঠামো না থাকায় এ খাতটিতে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালির বিপণন কৌশল নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। বিশাল অঙ্কের ছাড়, অফার দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি যেমন মানুষের মধ্যে আলোড়ন তুলেছে, তেমনি অনেকে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগও তুলেছে। আবার অনেকেই তাদের বিপণন কৌশলকে এমএলএম ব্যবসার সঙ্গে তুলনা করছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, একটি ই-কমার্সের লক্ষ্য হলো- প্রচুর ক্রেতা তৈরি করা। এটা এমনি এমনি হয় না। এজন্য অ্যাকশন পস্ন্যান থাকতে হয়। আমরা তা হাতে নিয়ে প্রচুর ক্রেতা ও বিক্রেতার সমাবেশ ঘটিয়ে এক নম্বর অবস্থানে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশের আইনবিরোধী কোনো কাজ আমরা করিনি।

বাংলাদেশে জিডিটাল কমার্স নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে ২০১৮ সালে। এ নীতিমালার লক্ষ্য- তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল কমার্স ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি করতে ব্যবসা- বাণিজ্যের ডিজিটাল রূপান্তর।

সম্প্রতি দেশে ডিজিটাল ব্যবসায় অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডবিস্নউটিও সেলের মহাপরিচলক হাফিজুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ১৯ সদস্যের পরার্শক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ট্রেড লাইসেন্সে ই-কমার্সকে অন্তর্ভুক্ত করা, ই-কমার্স পরিচালনা নীতিমালা এবং অভিযোগ নিষ্পত্তি বিষয়ে দুটি নীতিমালা প্রণয়ন, ই-কমার্স অভিযোগ সেল গঠন, বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা, ঋণপ্রাপ্তিতে সহায়তা, প্রতিবন্ধকতা ও ঝুঁকি চিহ্নিত করে দূরীকরণ, দেশীয় উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা, ভোক্তা অধিকার, লেনদেনের নিরাপত্তা, ডেলিভারি ব্যবস্থার উন্নয়ন, নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো, ক্রসবার্ডার রিটেইল ই-কমার্স নীতিমালা তৈরি, লজিস্টিক সাপোর্টের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে এ কমিটি।

জানতে চাইলে ডবিস্নউটিও সেলের মহাপরিচলক হাফিজুর রহমান বলেন, কমিটি পরামর্শ দেবে সেন্ট্রাল ই-কমার্স সেলকে, বিশেষ করে মন্ত্রণালয়কে। কমিটির প্রথম পরামর্শ হলো- ই-কমার্স উদ্যোগ পরিচালন নীতিমালা তৈরি। এরই মধ্যে একটি খসড়া হয়েছে, এ মাসের শেষে অংশীজনদের পরামর্শ নেওয়া হবে। তারপর এটি অনুমোদনের জন্য কেবিনেটে পাঠানো হবে। নীতিমালাটি ই-কমার্স উদ্যোগ এবং ভোক্তা অধিকার দুটি ক্ষেত্রকেই নিরাপদ করবে। কেউ যেন অন্যায়ের সুযোগ না নিতে পারে এমনভাবেই নীতিমালাটি করা হচ্ছে।

কমিটি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ই-কমার্স উদ্যোগগুলো ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করছে। কেউ কেউ সৃজনশীল পদ্ধতি তৈরি করে নিচ্ছে। আবার অনেক পদ্ধতি প্রতারণার ঘটনাও ঘটাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে একটা গাইডলাইন হচ্ছে। যেটি বাস্তবায়ন হলে ই-কমার্স ভালোভাবে বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হবে, কাস্টমারও প্রতারণার শিকার হবে না। আইনের দোহাই দিয়ে কেউ যেন বলতে না পারে যে আইনে বলা নেই কতদিনের মধ্যে ডেলিভারি দিতে হবে। আবার পণ্য ফেরত দেওয়া যাবে কি না, যদি যায় তাহলে অর্থ কীভাবে, কতদিনের মধ্যে ফেরত দেওয়া যাবে- এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু এখন নেই।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) প্রতিনিধিত্ব করছেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<112468 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1