অর্থনীতি সচল হলেও বেড়েছে দারিদ্র্য

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে

প্রকাশ | ২৫ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের ধারাবাহিক অর্জন থাকলেও কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ২০২০ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। হতদরিদ্র্যের হার বেড়েছে তিনগুণ। সেই সঙ্গে বেড়েছে বৈষম্যও। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে। মানুষের আয়, ব্যয়, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার ওপর মহামারির প্রভাব বিশ্লেষণ করতে এই গবেষণাটি করা হয়। ২০২০ সালের ২ নভেম্বর-১৭ নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৬০০টি বাড়ির মানুষের ওপর টেলিফোন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়। নমুনা জরিপের মাধ্যমে সানেমের এই গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ৪২ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। ২০১৮ সালে সানেম এবং পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) জরিপ অনুযায়ী এই হার ছিল ২১.৬ শতাংশ। শনিবার এক ওয়েবিনারে এই গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যার বু্যরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের দেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩ শতাংশ। ওয়েবিনারে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, শহর এবং গ্রামে উভয় ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৮ সালে গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৫ শতাংশ, যা ২০২০ সালে বেড়ে ৪৫.৩ শতাংশ হয়েছে। ২০১৮ সালে শহর এলাকায় দারিদ্র্যের হার ছিল ১৬.৩ শতাংশ, যা বেড়ে হয়েছে ৩৫.৪ শতাংশ। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহর এবং গ্রামীণ এলাকায় অতি দারিদ্র্যের হার তিন গুণ বেড়েছে। গ্রামীণ এলাকায় এই হার এখন ৩৩.২ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ১৯ শতাংশ। জাতীয় পর্যায়ে অতি দারিদ্র্যের হার ৯.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮.৫ শতাংশ হয়েছে। সানেমের জরিপ অনুযায়ী, দেশে এখন সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা রংপুর, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহ বিভাগ। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী বাস করে ময়মনসিংহে। এর আগে ২০১৬ সালের বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, সর্বোচ্চ হতদরিদ্রের সংখ্যা ছিল রংপুর বিভাগে। হতদরিদ্রের সংখ্যা বিবেচনায় বর্তমানে রংপুর বিভাগ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে অর্ধেক পরিবারের খাদ্যের ওপর ব্যয় কমেছে। এ ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যে ব্যয় এবং খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় দুটিই কমছে। তবে খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় বেশি কমেছে। মানুষ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমিয়ে খাদ্য কিনতে বেশি অর্থ ব্যয় করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে যারা হতদরিদ্র ছিল, তাদের ৪৯.২ শতাংশ ২০২০ সালেও হতদরিদ্রসীমায় রয়ে গেছে। আবার ২১০৮ সালে দারিদ্র্যসীমায় থাকা জনগোষ্ঠীর ৪১ শতাংশ হতদরিদ্র্যসীমায় নেমে গেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যের সঙ্গে বৈষম্যও বেড়েছে। ২০১৮ সালে দেশে গিনি কোএফিসিয়েন্ট মান ছিল ০.৩১। যা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ০.৩৩, অর্থাৎ বৈষম্য বেড়েছে। জরিপ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোভিডের মধ্যে দেশে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ধনীর আয় ও ভোগ ব্যয় বেড়েছে। এ সময় দেশে সবচেয়ে কম আয়ের ২০ শতাংশ দরিদ্রের আয় ও ব্যয় কমেছে। ২০১৮ সালে দেশে ৫ শতাংশ ধনীর ভোগ ব্যয় ছিল ১২.৯ শতাংশ। যা ২০২০ সালে বেড়ে হয় ১৩.৯২ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৮ সালে সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশ মানুষের ব্যয় ছিল ৯.৬ শতাংশ, যা ২০২০ সালে কমে হয় ৬.৪৭ শতাংশ। গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিডের মধ্যে মাত্র ২১ শতাংশ পরিবারের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে বা টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত ছিল। দরিদ্র পরিবারগুলোর সন্তানদের মধ্যে ১৫ শতাংশ এবং ধনীদের ২৬ শতাংশ অনলাইনের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। সেলিম রায়হান বলেন, কোভিডের কারণে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সেবা খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে। ফলে কাজ হারানো মানুষরা কৃষি খাতে যোগ দিয়েছেন। তবে শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের পরিমাণ অপরিবর্তিত রয়েছে। দেখা গেছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে স্বনিভর কর্মসংস্থানের হার কমেছে। বেড়েছে বেতনভুক্ত নিয়োগপ্রাপ্তের সংখ্যা। এ ছাড়া দিনমজুরদের সংখ্যাও সামান্য কিছু কমেছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে সারাদেশে কাজ হারিয়েছে ৯.৭ শতাংশ কর্মী। এ সময় ৪৮.৭২ শতাংশ পরিবারের ঋণ করে খরচ জোগাতে হয়েছে। মাত্র ৫.৩২ শতাংশ মানুষ সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছে বলে জরিপে উঠে এসেছে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধা পেয়েছে ২৫.৯১ শতাংশ মানুষ। কোভিডের মধ্যে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও পরিবারগুলোর তথ্যানুযায়ী, তারা আগের তুলনায় কম রেমিট্যান্স পেয়েছে। সেলিম রায়হান বলেন, আগে ব্যাংক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক (হুন্ডি) মাধ্যমে প্রবাসীদের পরিবারগুলো এই রেমিট্যান্স পেত। কোভিডের মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেড়েছে। তবে মোট রেমিট্যান্স কমে গেছে। জরিপে পাঁচটি সুপারিশও উঠে এসেছে। এর মধ্যে কোভিড পরিস্থিতিতে ব্যবস্থাপনা জোরদার করা, ক্যাশ প্রণোদনা কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা, দুর্নীতি কমানো এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কেবল ভোগের ক্ষেত্রে নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রেও দারিদ্র্য বেড়েছে।