দেশের করোনার এক বছর

স্বাভাবিকতার পথে অর্থনীতির সূচক

প্রকাশ | ০৯ মার্চ ২০২১, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
গত বছর মার্চে দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণের আগ থেকেই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মহামন্দার শঙ্কা দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় স্থবির হয়ে পড়ে আমদানি রপ্তানিসহ দেশের শিল্পোৎপাদন। ক্রমেই ভেঙে পড়ে পর্যটনসহ সব ধরনের সেবা খাত। দেশের উৎপাদনমুখী বিভিন্ন খাতের প্রবৃদ্ধি নেমে প্রায় শূন্যের কোঠায়। এই চিত্র বিশ্বের বাকি অর্থনীতিগুলোতেও। হঠাৎ বেড়ে যাওয়া কর্মহীনতা, দারিদ্র্য অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই ছিল নিম্নমুখী। তবে মহারিতে রাজস্ব আয়ের পতন ও ব্যাংক খাতে লেনদেনের নেতিবাচক ধারার ফলে যে শঙ্কা তৈরি করেছিল তা অনেকটাই কেটে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে করোনা সংক্রমণের এক বছররের মাথায় অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের সার্বিক অর্থনীতি। এদিকে বছরের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে মিলেছে এমন আভাস। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, দেশের অর্থনীতি এখন করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরছে। এছাড়া ভালো অবস্থানে রয়েছে দেশের শেয়ার বাজর। \হচলতি মাসে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, দেশের অর্থনীতির চাকা এখন অনেক বেশি গতিশীল। স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে বৈদেশিক শ্রমবাজার ও রেমিট্যান্স। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৪ হাজার ৩১৪ জন বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যেতে পেরেছেন, যা গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় প্রায় ২১ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে এ সময় ঋণের চাহিদাও বেড়েছে। ডিসেম্বরে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে আগের মাসের তুলনায় ১ দশমিক ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় এ বৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৯১ শতাংশ। নভেল করোনাভাইরাসের আঘাতে দেশের ব্যাংক খাতের লেনদেনে স্থবিরতা নেমে এসেছিল। লেনদেন কমে গিয়েছিল চেক, ইএফটি, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডসহ সব ডিজিটাল মাধ্যমেই। গত বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোয় চেকের মাধ্যমে লেনদেন কমে গিয়েছিল ৩০ শতাংশের বেশি। ওই প্রান্তিকে চেকের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ৪ লাখ ৭ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। করোনার বিপর্যয় কাটিয়ে গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোতে চেকের মাধ্যমে লেনদেন ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। চেকের মাধ্যমে হওয়া লেনদেনের এ পরিসংখ্যান ২০১৯ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের চেয়েও বেশি। ২০১৯ সালের শেষ প্রান্তিকে চেকের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। চেকে লেনদেনের মতোই ইএফটি, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডসহ ডিজিটাল ব্যাংকিং লেনদেন করোনার আগের অবস্থায় ফিরেছে। কিছু ক্ষেত্রে মহামারিপূর্ব অবস্থা থেকেও এ লেনদেনের সংখ্যা অনেক বেশি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। সরকারের দেওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ও কৌশলগুলো বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখছে। সংকট কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশকে কয়েক বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে বহুপক্ষীয় ব্যাংক ও দ্বিপক্ষীয় অংশীদাররাও। এদিকে করোনায় সম্প্রসারণমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণের কারণে বাজারে মুদ্রা ও ঋণের সরবরাহ বেড়েছে বলে জানিয়ে ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সম্প্রতি তিনি বলেন, করোনাকালে বড় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে অর্থনীতির সূচকগুলো সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। ফলে মহামারি পরিস্থিতিতে অর্থনীতির সূচকগুলো ভেঙে পড়েনি। এছাড়া প্রণোদনার অর্থ সরাসরি সুবিধাভোগীর ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হয়েছে। এতে অর্থের অপচয় কম হয়েছে। আবার যারা সুবিধা পাওয়ার যোগ্য কিন্তু পাননি, তাদের অর্থ আমাদের কাছে রয়েছে। সুবিধামতো সময়ে দেওয়া হবে। সরকারের সব সংস্থা ও কর্মকর্তারা টিম হিসেবে কাজ করার কারণেই অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। সংকটকালে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন অভিবাসী শ্রমিকরা। এ সময়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে রেকর্ড পরিমাণে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেশি। ফেব্রম্নয়ারিতেও আগের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। গত মাসের প্রথম ২৩ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪৯ কোটি ডলার। রেমিট্যান্সের এ উচ্চপ্রবৃদ্ধিই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশী মুদ্রায় বর্তমান রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে দেশের প্রায় এক বছরের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব। দেশের ব্যাংক খাতের লেনদেন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরেছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো থেকে আমরা যে পরিসংখ্যান পাচ্ছি, তা আশাব্যঞ্জক। দেশের ব্যাংক খাতের সূচকগুলো করোনাপূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরেছে। রেমিট্যান্সের উচ্চপ্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের রপ্তানি খাতও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমদানি প্রবৃদ্ধি ফিরে এসেছে। অর্থনীতির সব সূচকই প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেরাটা বড় অর্জন। দেশব্যাপী করোনাকালে লাখো মানুষ চাকরি হারিয়েছে। দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়েছে। ছোট ও ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। সামগ্রিক প্রভাবে দেশের সিংহভাগ মানুষের আয় কমে যায়। আমদানিকারক দেশগুলো তাদের বাণিজ্য সচল রাখতে হিমশিম খাওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি খাত বড় ধাক্কা খায়। ২০২০ সালের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে রপ্তানি (ফ্রি অন বোর্ড) প্রায় ৫ শতাংশ কমেছে। তবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রপ্তানির পরিমাণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে মাত্র ১ শতাংশ। ফলে ধীরে হলেও গতি ফিরছে রপ্তানি খাতে। ব্যাংকগুলোয় আমদানি-রপ্তানির এলসি খোলার হার বাড়ছে। পোশাক শিল্প খাতের কারখানাগুলোও প্রায় পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করেছে। এ খাতের স্থগিত হওয়া অর্ডারগুলো ফিরে আসছে। রপ্তানি খাতের প্রবৃদ্ধি এখন নেতিবাচক হলেও তার মাত্রা আগের চেয়ে কমেছে। বর্তমান ক্রয়াদেশ ফিরতে শুরু করলেও মারাত্মক মূল্য চাপ মোকাবিলা করছেন শিল্পমালিকরা। গত ডিসেম্বরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। সর্বশেষ ফেব্রম্নয়ারিতে রপ্তানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির হার নেমেছে ঋণাত্মক ৩ দশমিক ৯২ শতাংশে। রপ্তানির এ পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে আরও সহযোগিতা করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কোভিডের প্রভাবে বিনিয়োগেও স্থবিরতা দেখা দেয়। গত এপ্রিল-মে মাসে ব্যাপকহারে পতন ঘটে নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রস্তাবে। সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতিতে আবারও পরিবর্তন আসতে শুরু করে। স্থানীয় বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করেছে স্থানীয় বড় করপোরেটরা। পাশাপাশি দেশের অবকাঠামো খাতে বড় বিনিয়োগের আগ্রহ বাস্তবায়নের তাগিদ দেখাতে শুরু করেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। বৈদু্যতিক রেলেই ১২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আগ্রহ বাস্তবায়নের তৎপরতা দেখা গিয়েছে সম্প্রতি। এ বিষয়ে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ২০২১ সালে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে আমরা অনেক আশাবাদী। বিশ্বের অনেক দেশের বিনিয়োগকারীই বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে নতুন সম্ভাবনাও দেখা দিচ্ছে। বিনিয়োগ ও ব্যবসার সেবাগুলো সহজ করতে অনেক ধরনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে, বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিস বিধিমালাও জারি হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বেশি আকর্ষণীয় হবে বলে আমি আশা করি। আমদানি-রপ্তানি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বৃদ্ধির ফলে রাজস্ব আহরণও বাড়ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা ঘাটতি থাকলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রাজস্ব আহরণ হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বেশি। সাত মাসে আহরণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আহরণ হয়েছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। এক মাস হিসাবে গত জানুয়ারিতে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ২১ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি।