বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আইনি দুর্বলতায় নিয়ন্ত্রণহীন তামাক ব্যবহার

আহমেদ তোফায়েল
  ২৯ জুলাই ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ২৯ জুলাই ২০২১, ১১:১৮

তামাকপণ্য প্রকৃতপক্ষে মৃতু্যদূত। তামাকজাত পণ্য যেমন- বিড়ি, সিগারেট জর্দা-গুল ইত্যাদি মানুষকে নেশায় আসক্ত করে, এমনকি মাদকের দিকে ঠেলে দেয়। একজন সুস্থ সবল মানুষ ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে থাকে এবং অনেকেরই মৃতু্য ঘটে। ধূমপানের কুপ্রভাব গ্রাস করছে পৃথিবী, বিশেষ করে তরুণসমাজ এর বিষাক্ত নেশার কবলে পড়ছে। বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃতু্যর প্রধান ৮টি কারণের মধ্যে ৬টির সঙ্গেই তামাক জড়িত। ধূমপান নিয়ে সারা বিশ্বের চিকিৎসক, গবেষক মহলের ভাবনার শেষ নেই। ধূমপানবিরোধী সচেতনতার লক্ষ্যে ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এত সেমিনার, প্রচারণা, এত লেখালেখি- তবুও তামাকের ব্যবহার হুহু করে বেড়ে চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে তামাকই হবে আগামীদিনের মহামারি। তামাকের এই ভয়াল ক্ষতি প্রতিরোধে ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ সরকার জনস্বাস্থ্যের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এফসিটিসি'র আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ প্রণয়ন করে। ২০১৩ সালে তামাক আইনের গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন হয়। এই আইন ও বিধিমালার উলেস্নখযোগ্য দিকগুলো হলো- পাবলিক পেস্নস ও গণপরিবহণে ধূমপান নিষিদ্ধ, তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিষিদ্ধ, অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণ নিশ্চিত করা। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নে বাংলাদেশ উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। আইনের দুর্বলতাকে পুঁজি করে তামাক কোম্পানিগুলো, তামাক ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটেই যাচ্ছে। মৃতু্যর কালো ধোঁয়া তারা বাজারজাত করছে আকর্ষণীয় মোড়কে! তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধে রয়েছে দুর্বলতা, যা তামাক নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা। তাছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধকরণের ক্ষেত্রেও রয়েছে আইনি দুর্বলতা। তামাক ব্যবহারের সহজলভ্যতা তরুণ সমাজ ও স্বল্পআয়ের মানুষদের ধূমপানের আগ্রহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়াও পাবলিক পেস্নসে অবাধ ধূমপান শুধু সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোকিংয়ের ভয়াবহতাই ছড়িয়ে দিচ্ছে না, বরং এর প্রভাবে কৌতূহলি হয়ে পড়ছে কিশোর-তরুণরা। ধূমপান এখন শুধু নেশা নয়, অনেকটা ফ্যাশন! ধূমপায়ীদের একটা বড় অংশ অন্যদের দেখে কৌতূহলবশত এই নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। আইনে আছে, কোনো ব্যক্তি কোনো পাবলিক পেস্নস এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান করতে পারবে না। আবার নিম্নোক্ত বেশকিছু ক্ষেত্রে পাবলিক পেস্নস ও পাবলিক পরিবহণে ধূমপানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যেমন, চার দেওয়ালে আবদ্ধ নয় এমন রেস্তোরাঁ, কোনো কোনো পাবলিক পেস্নসে নির্ধারিত এলাকায় ধূমপান, একাধিক কক্ষবিশিষ্ট গণপরিবহণ, সবধরনের অযান্ত্রিক পাবলিক পরিবহণ ইত্যাদি। আইনের এই নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনিয়ম হচ্ছে। বর্তমানে অনেক হোটেল, রেস্তোরাঁ, কফিশপ ইত্যাদি রয়েছে যেগুলোর চারপাশ দেওয়াল দ্বারা আবদ্ধ নয়। সেসব জায়গাসহ সব ধরনের পাবলিক পেস্নস, কর্মক্ষেত্র ও গণপরিবহণে ধূমপানসহ সব ধরনের তামাক পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ধূমপানমুক্ত ভবন বলতে সেই ভবনের বারান্দাসহ সব আচ্ছাদিত স্থানকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। কর্মক্ষেত্র, রেস্তোরাঁসহ পাবলিক পেস্নসকে শতভাগ ধূমপানমুক্ত করা গেলে সেখানে আগত অধূমপায়ীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ৮৫% পর্যন্ত হ্রাস পাবে এবং তামাকের ব্যবহারও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। ধূমপান নিয়ন্ত্রণে কেবল জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো, অথবা সরকারি-বেসরকারি সংগঠনগুলোর উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি প্রয়োজন জরুরি আইনের কঠিন প্রয়োগ। জনগণের সচেতনতার পাশাপাশি আইন প্রয়োগ এতটাই কার্যকর করতে হবে যাতে কোনো শক্তি এই বাধা অতিক্রম করতে না পারে। তাছাড়া তামাক ব্যবসায়ীরা এভাবেই হাতিয়ে নিতে থাকবে টাকার পাহাড় আর অধূমপায়ীরা পরবে ক্ষতির গভীর কূপে। ২০১৬ সালে ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় স্পিকার্স সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক নির্মূল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি তামাক নিয়ন্ত্রণে বদ্ধপরিকর। এজন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও এফসিটিসি'র সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংশোধনের ঘোষণাও দেন। বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা সংশোধন করতে পারলেই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়ন সম্ভব, যা জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হ্রাসে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে