কানাডার জোয়ে ফ্রেশ ফ্যাশনের উদ্যোক্তা জোয়ে মিমরান

‘আইডিয়াকে জুয়া হিসেবে নিয়েছি’

বিবিসির সাপ্তাহিক বস সিরিজে কোনো না কোনো সফল মানুষের গল্প থাকে। থাকে তাদের উত্থান-পতনের ইতিকাব্য। কানাডার বিবিসির সংবাদদাতা ডেভ গডর্ন হাজির হয়েছেন জোয়ে ফ্রেশ ফ্যাশনের উদ্যোক্তা ও ক্লাব মোনাকোর মহারথী জোয়ে মিমরানের দরবারে। মিমরানের উত্থান-পতনের বৃত্তান্ত ইংরেজি থেকে বাংলায় তুলে ধরেছেন ইমদাদ হোসাইন।

প্রকাশ | ১৮ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
জোয়ে মিমরান
মৃদুভাষী, বিনয়ী, ভদ্র কিন্তু দৈঘের্্য প্রস্থে হাসির রেশটা বেশ চওড়া। জোয়ে মিমরানকে কিছুতেই মনে হবে না যে তার ভেতরে ড্রাগনের আগুন দাউ দাউ করে কিভাবে জ্বলছে! তার এমন রূপ দেখা যাবে কানাডার উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি টেলিভিশন শো ‘ড্রাগনস ডেন’-এ। অনুষ্ঠানটিতে সচরাচর উদ্যোক্তাদের স্বপ্নে আগুন ধরিয়ে দেন তিনি। আপনি একটি আইডিয়া নিয়ে বুকের ভেতর লালন করছেন, তার সে অনুষ্ঠানে গেলে আপনি অনুধাবন করতে পারবেন আপনার স্বপ্নের গুরুত্বটা আসলে কি। জোয়ে মিমরানের বয়স এখন ৬৫। মরক্কোতে জন্ম নেয়া একজন ইহুদি, বতর্মানে কানাডিয়ান অভিবাসি। পুরো জীবনটাই কেটেছে ফ্যাশন নিয়ে কাজ করে। বেশি পরিচিতি জোয়ে ফ্রেশ ও ক্লাব মোনাকোর চালক হিসেবে। তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে শত উত্থান-পতনের কাব্য। এখনো ভাবেন, তার প্রতিযোগীদের তুলনায় তিনি এখনো স্মাটর্ হয়ে উঠতে পারেননি। তার ভাষ্য, ‘জীবনভর ফ্যাশনকে ভালোবেসেছি, সব সময়ই একজন উদ্যোক্তা হতে চেয়েছি।’ বয়স তখন সবে ১২। তার মা তাকে একটি স্যুট বানিয়ে দিল। কারণ তিনি সিন কুনারির মতো পোশাক পরতে চেয়েছিলেন। বাবার মুদির ব্যবসা আর মায়ের ছোট্ট একটি দজির্র দোকান। এই দজির্ দোকানে বেশিরভাগই পুরুষের স্যুট তৈরি করতে হতো। মিমরানের মাথায় মায়ের দজির্র ব্যবসাটাই কল্পনার জগতে স্থান করে নিল। তিনি মাকে সব ধরনের সাহায্য সহায়তা দিতে শুরু করলেন। কিছুদিনের মাথায় টরোন্টোর গামের্ন্ট পল্লীতে একটি কারখানা দিয়ে বসলেন। মা অনুরোধ করলেন, ব্যবসাকে বড় করার চেষ্টা করতে থাক। পারিবারিক এই কারখানায় প্রাথমিকভাবে শুধু মহিলাদের কাপড় সেলাই করা হতো। কিন্তু জোয়ে ও তার ভাই পল এক পা সামনে এগিয়ে ভাবলেন। আলফ্রেড সাং নামের একজন ডিজাইনারকে ভাড়া করে আনলেন। ডিজাইনারকে তাদের পছন্দ মতো পোশাক বানিয়ে দিতে বললেন। ব্যস, তা নিয়েই দুই ভাই রাজপথের ফুটপাতে দঁাড়িয়ে গেলেন। কোনো কোম্পানি এটি কখনো ভাবতেই পারেনি। তিনি বলেন, এটি আমার খুব মনে ধরেছিল, আর এই আইডিয়াকেই জুয়া হিসেবে বেছে নিয়েছি।’ ১৯৮০ সালের মাঝামাঝিতে একদিন শপিংয়ে বেরুলেন। দোকানে গিয়ে প্লেইন সাদা টি-শাটর্ খেঁাজ করছিলেন। কিন্তু পছন্দসই কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনি আইডিয়া খুঁজে পেলেন। সেখানেই ভাবলেন একটি যুতসই পোশাকের ব্র্যান্ড তৈরি করা যায় কিনা। কানাডায় ফ্যাশন হাউসগুলোতে তখন মন্দাভাব। ক্লাব মোনাকো এসে সিদ্ধান্ত নিল, দুই বছরে জঁাকজমকভাবে এসে তাদের ব্যবসা আর চালানো সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে কানাডার দুটি ডিপাটের্মন্টাল চেইন স্টোর, দ্য বে এবং ইটোনস জানিয়ে দিয়েছে তাদের ব্যবসাও সঙ্কুচিত করতে হচ্ছে। মিমরান পড়লেন বিপদে। কারণ তারা সেখানে পোশাক সরবরাহ করতেন, এখন পোশাক সরবরাহ করবেন কোথায়? তিনি বলছিলেন, আমরা বুঝতে পারছিলাম আমাদের সব তৈরি পোশাক ঘরেই রাখতে হবে। নিজেদের একটি ফ্যাশন হাউস খুলে সেখানে বিক্রি করতে হবে। কারণ এই সিদ্ধান্তটি অস্বাভাবিক হলেও সত্যি। কারণ খুচরা বিক্রেতারা তো পাইকারদের কাছ থেকে পোশাক নিচ্ছেই, আমাদের কাছ থেকে কেন নেবে?’ শেষ যে বার ক্যারিয়ারের স্বপ্ন নিয়ে জুয়া খেলেছিলেন, এবারও আরেকবার জুয়া খেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। ডিজাইনার আলফ্রেড সাংকে ফের ডাকলেন, তার বেতন বাড়িয়ে দিলেন। আবার স্বপ্ন নিয়ে ঝঁাপ দিলেন। বাজি ধরেই এগুলেন। মিমরানের ভাষায়, টরেন্টোতে যখন নিজেদের প্রথম স্টোর দঁাড় করালাম তখন সবাই দল বেঁধে আমাদের স্টোরে আসতে লাগলো। মাঝে মধ্যে কারো কানপড়া না শুনে নিজের কাজে ঝঁাপ দিতে হয়।’ একবার তার এক সেলসম্যান ক্রীড়া পোশাক কারখানা খোলার ব্যাপারে তাকে বারণ করল। মিমরানকে সেলসম্যান বুঝাতে চাইল এই বাজার সম্পকের্ যেহেতু কোনো ধারণা নেই, অভিজ্ঞতা নেইÑ না এগুনোই উত্তম। মিমরান তার কথায় কণর্পাত করলেন না। বরং ওই সেলস্যমানকে বরখাস্ত করলেন তিনি। মিমরান বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের কত ধরনের সমস্যা থাকে। সেগুলোকে সঙ্গী করেই এগুতে হয়। কিন্তু সব সময়ই নিজের স্বপ্ন আর আইডিয়াকে মাথায় পুষে রাখতে হয়। কখনোই নিজের আইডিয়া নিয়ে কোনো অভিজ্ঞ মানুষের কাছে যাবেন না। অভিজ্ঞরা নতুন আইডিয়ার বাস্তবায়ন কখনোই পারেননি, পারবেন না বরং বাধা হয়ে দঁাড়ায়। তিনি ক্লাব মোনাকোর জন্য কাজ করে যেতে লাগলেন। ক্লাব মোনাকো নিউইয়কের্ও স্টোর খুলে তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়াল। পরে ১৯৯৯ সালে ক্লাব মোনাকো ৫২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আরেক জায়ান্ট কোম্পানি পলো রাফ লরেনের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। তারপর থেকে মিমরান অবশ্য নতুন আরেকটি ব্র্যান্ড তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। নাম দিলেন জোয়ে ফ্রেশ। এই পোশাক বানাতেন শুধু চেইন সুপারমাকের্ট লোবলের জন্য। এই চেইন সুপার মাকের্ট শুধু কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা পরিচালনা করত। মায়ের কাছ থেকে শেখা কারুকাজ তাকে অনেক দূর নিয়ে গেল। তবে তাকে চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হয়েছে। ফাস্ট ফ্যাশন নামের একটি অনলাইন খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি এসে সচরাচর ডিপাটের্মন্টাল স্টোরগুলোর সব বদলে দিল। প্রতিষ্ঠানটির কিছু ডিজাইনার তার মতো করেই পোশাকের ডিজাইন করতে শুরু করল। মিমরানের টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়ল। মিমরান জানান, আগে তো পণ্য বিক্রির জন্য নিদির্ষ্ট স্থান থাকত। এখন সোস্যাল মিডিয়ার যুগ, এক ক্লিকেই বিশ্ব হাতে পাওয়া যায়। আপনাকে অ্যাপের চেয়ে দারুণ গতি সম্পন্ন হতে হবে। এই অনলাইন বিশ্ব মিমরানকে নতুন ব্যবসায় জড়াতে বাধ্য করল। ইউএস ডিপাটের্মন্ট স্টোর জায়ান্ট জেসি পেনি ২০১৫ সালে খাদের কিনারায় এসে দঁাড়িয়েছিল। তিনি এই কোম্পানির সঙ্গে রিসেল চুক্তি করেন। এই কোম্পানির এখন নিউইয়কের্ সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। তার ভাষায়, ফ্যাশন জগতে সাফল্যের কোনো গ্যারান্টি নেই। নতুন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে তিনি যখন কথা বলেন তাদের ভাষা বোঝার চেষ্টা করেন তিনি।