খেলাপিতে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বাড়ছে

প্রকাশ | ০৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোটর্
যাচাই-বাছাই ছাড়া নামসবর্স্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর নিয়মকানুন না মেনে ঋণ দেয়ায় তা আদায়ও করা যাচ্ছে না। ফলে ওইসব খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনও রাখতে হচ্ছে। তাতে মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে ব্যাংক। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। অবশ্য খেলাপি ঋণ কমাতে দেদার ঋণ পুনঃতফসিল করছে বেশিরভাগ ব্যাংক। এর পরও না কমে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এর প্রভাবে মূলধন ঘাটতি মেটাতে ব্যথর্ হয়েছে ৯টি ব্যাংক। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পযর্ন্ত এসব ব্যাংকের ১৯ হাজার ৬২ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এক বছর আগে আট ব্যাংকে ১৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভনর্র খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। আর খেলাপি ঋণের কারণেই মূলধন ঘাটতিও বাড়ছে। বেসরকারি ব্যাংকে ঘাটতি বেশি না হলেও সরকারি খাতে ঘাটতি অনেক বেশি। সরকারি ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের ঘাটতি পূরণ করা হয় জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে। যা মোটেও উচিত নয়। এটি বন্ধ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণ স্থিতি দঁাড়িয়েছে ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়ে যাওয়া ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। তিন মাস আগে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৫২২ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খেলাপি ছিল ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৭ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। যার বিপরীতে খেলাপি ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, যা ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই মূলধন ঘাটতি বাড়ে। ৯টি ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের মূলধন ঘাটতি থাকলেও কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি রাখতে সক্ষম হয়েছে। মূলধন ঘাটতির তালিকায় থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে ছয়টি সরকারি মালিকানার। বাকি তিনটি বেসরকারি খাতের। সরকারি ছয় ব্যাংকে ঘাটতি রয়েছে ১৭ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। এক বছর আগে সরকারি ছয় ব্যাংকে ১৫ হাজার ৯০৯ কোটি টাকার ঘাটতি ছিল। এসব ব্যাংকের দক্ষতা না বাড়িয়ে জনগণের করের টাকায় বারবার মূলধন জোগান নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে। কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অথর্বছরের বাজেটে সরকারি ব্যাংকের জন্য দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সেপ্টেম্বরে জনতা ব্যাংকের সবোর্চ্চ মূলধন ঘাটতি ৩ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির ঘাটতি ছিল মাত্র এক হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। একইভাবে বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা। গত বছর ছিল ২ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের ৬৯০ থেকে কমে মূলধন ঘাটতি নেমে এসেছে ২৮৬ কোটি টাকায়। অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি আগে না থাকলেও এবার ৬৬২ কোটি টাকায় পড়েছে। বরাবরের মতো এসব ব্যাংকের মধ্যে মূলধন ঘাটতির শীষের্ রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি দঁাড়িয়েছে ৮ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। এক বছর আগে যা সাত হাজার ৫৪০ কোটি টাকা ছিল। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ৭৪৩ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ৬৬৯ কোটি টাকা। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি পড়লেও এবার পুরোপরি বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। বতর্মানে ব্যাংকটির কোনো মূলধন ঘাটতি নেই। বেসরকারি খাতের আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি এক হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দঁাড়িয়েছে এক হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ কমাসর্ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২৩১ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০৮ কোটি টাকা। এছাড়া এসআইবিএলের ঘাটতি ৩৫ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর শেয়ার-হোল্ডার বা মালিকদের জোগান দেওয়া অথর্ই মূলধন হিসেবে বিবেচিত। সারাবিশ্বে ব্যাসেল কমিটি প্রণীত আন্তজাির্তক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে বতর্মানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে একটি ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি সে পরিমাণ মূলধন রাখতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক দিন ধরেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরছে না। উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগে আসছেন না। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেকেই শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বাড়ছে না, অন্যদিকে আগে বিতরণ হওয়া ঋণের টাকাও ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংক। ফলে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সা¤প্রতিক সময়ে যে সুদহার কমেছে তার ইতিবাচক প্রভাব ব্যাংকিং খাতে পড়তে সময়ে লাগবে বলেও মনে করছেন তারা। আর বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা কিছুটা কাজে লাগলেও সামগ্রিকভাবে তা খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না বলে জানান তারা। এছাড়া জাতীয় নিবার্চনের দিকেও তাকিয়ে ছিলেন বিনিয়োগকারীরা।