অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে ব্যাংকের অনীহা

১৫ বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে অবলোপনে আগ্রহী ব্যাংক গত বছরের সেপ্টেম্বরে অবলোপন করা হয়েছে ৭৬ শতাংশ কৃত্রিমভাবে ব্যাংকের আথির্ক সক্ষমতা বাড়াতে অবলোপন বাড়ছে এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং খাতে বিপযের্য়র আশঙ্কা

প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

ওবায়দুর রহমান
খেলাপি ঋণের বোঝা হালকা করতে ২০০৩ সালে ঋণ অবলোপনের (রাইট অফ) সুবিধা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে গত ১৫ বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করেছে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক। অবলোপন করলে সেই ঋণ আদায়ে ব্যাংকের শাখা কমর্কতাের্দর দায়িত্ব অনেকাংশে কমে যায়। যার কারণে শাখা কমর্কতার্রা যেসব খেলাপি ঋণের অথর্ আদায় করতে বেগ পান, সেই ঋণ অবলোপনের জন্য পরিচালনা পষের্দ পাঠাতে সুপারিশ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকে অবলোপকৃত ঋণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকের আগ্রহ না থাকায় গত ১৫ বছরে ব্যাংক তাদের অবলপকৃত ঋণের মাত্র এক-চতুথার্ংশ আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকলে তাদের চ‚ড়ান্ত হিসাব পরিষ্কার করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে খেলাপি ঋণ অবলোপনের অনুমতি দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, ২০০৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পযর্ন্ত ব্যাংক মোট ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা অবলোপন করেছে। যার মধ্যে গত সেপ্টেম্বরেই অবলোপন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। যা মোট অবলোপকৃত ঋণের ৭৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে খেলাপি এবং অবলোপকৃত মোট ঋণের পরিমাণ দঁাড়িয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভনর্র ড. সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবলোপনের অনুমিত দিয়েছিল ব্যাংকের আথির্ক অবস্থার উন্নতির জন্য। তবে তাদের আন্তরিক চেষ্টার অভাবে খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ উদ্ধারে এই নীতিমালা কোন কাজে আসেনি। তিনি আরও বলেন, কু-ঋণ এবং অবলোপন দুটিই ব্যাংকের খারাপ পরিস্থির জন্য দায়ী। এগুলো বাড়ার অথর্ হচ্ছে খেলাপি ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে ঋণের টাকা উদ্ধারে ব্যাংকের অক্ষমতা বাড়ছে। এর মানে হল খারাপ ঋণ উদ্ধারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। বরং খারাপ ঋণের পরিমাণ দিন দিন আরও বাড়ছে। ঋণ অবলোপনের এই উচ্চ হার আথির্ক খাতে খুব খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর পযর্ন্ত বছরে ৫.২৩ শতাংশ হারে ঋণ অবলোপন বৃদ্ধি পেয়ে ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকায় দঁাড়িয়েছিল। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক অবলোপন করে ১৮ হাজার ১১১ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংক অবলোপন করে ১৮ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী ?কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ঋণ অবলোপন করে ৩৪৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে বিদেশি ব্যাংক করে ৯৪৪ কোটি টাকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকাসের্র (এবিবি) সভাপতি মাহাবুবুর রহমান বলেন, ঋণ দাতা যখন দেখে খেলাপি ঋণ কোনোভাবেই আদায় হবে না। তখন সে অবলোপন করে। ঋণ গ্রহীতারা অধিকাংশ সময় ঋণ নেয়ার জন্য সমপরিমাণ জামানত রাখে না। যার কারণে কোনো ঋণ অবলোপন করা হলে সেটি আদায় ?খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের খারাপ পরিস্থিতি থেকে বঁাচতে ঋণদাতাকে ঋণ অনুমোদন দেয়ার আগে ঋণ গ্রহীতার ব্যবসার সাবির্ক পরিস্থিতি এবং নগদ অথের্র প্রবাহ যাচাই করার পরামশর্ দেন ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহাবুবুর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডিপুটি গভনর্র খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংক সাধারণত তাদের চ‚ড়ান্ত হিসাবকে পরিষ্কার রাখতে ঋণ অবলোপন করে থাকে। কিন্তু এ ধরনের পদ্ধতি ব্যাংকিং খাতে ভালো কোনো ভাবমূতির্ তৈরি করে না। কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি থাকলে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে বিদেশি ব্যাংক বেশি চাজর্ করে। যার কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে রাখে। তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত উচ্চ আদালতে কমপক্ষে দুটি বেঞ্চ গঠন করে খেলাপি ও অবলোপকৃত ঋণের যে মামালা রয়েছে সেগুলো নিষ্পত্তি করা। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঋণ খেলাপিরা আইনের ফঁাক গলে বেরিয়ে যান। সাউথ ইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসান বলেন, ‘অনেক ব্যাংকই ঋণ অবলোপন করতে পারে না। কারণ অবলোপন করতে হলে সমপরিমাণ টাকা সঞ্চিতি রাখতে হয়। আমার ব্যাংক গত বছর মুনাফার ২৫২ কোটি টাকা অবলোপন করেছে। যা চ‚ড়ান্ত হিসাব পরিষ্কার রাখতে সহয়তা করেছে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের শাখাগুলো তাদের বই থেকে ঋণ অবলোপন হলে স্বস্তি পায়। কারণ তারা মনে করে, ঋণের এই টাকা আদায়ে তাদের কোনো দায় থাকল না। তবে এ ধরনের মনোভাব খেলাপি ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে টাকা উদ্ধারে সহায়ক নয়।