ভ্যাট ফঁাকিরোধে ব্যাংকগুলোতে সফটওয়্যার বসাচ্ছে এনবিআর

প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

ইমদাদ হোসাইন
শতভাগ ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করতে মাঠে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোডর্ (এনবিআর)। এর অংশ হিসেবে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব সফটওয়্যার বসাতে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা যাতে কোনোভাবেই ভ্যাট ফঁাকি দিতে না পারে সেজন্য প্রাথমিকভাবে দেশের ১৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে এই সফটওয়্যার ইনস্টল করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এনবিআর সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। প্রাথমিকভাবে এই কাযর্ক্রম সফলতার মুখ দেখলে খুব শিগগিরই দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকে এমন সফটওয়্যার ইনস্টল করবে বলে জানিয়েছে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)। এলটিইউর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আমানতকারীদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো যে ভ্যাট আদায় করে থাকে তা সঠিকভাবে সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। ওই প্রতিবেদনে দেশের কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে কর ফঁাকির অভিযোগও উঠে এসেছে। এলটিইউর প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এনবিআরের কর আদায়কারী কমর্কতাের্দর অবহেলায় দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক থেকে করের উৎস হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের ৩৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে উৎসের কাছ থেকে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ভ্যাট আদায় করেও তা সরকারকে সঠিকভাবে না দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। সরকারের চোখ ফঁাকি দিয়ে দেশের ওই ব্যাংকগুলো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কর ফঁাকি দেয়ার প্রবণতা বেশ আগে থেকেই। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এলটিইউ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর ফঁাকির প্রবণতা রুখতে সফটওয়্যার ইনস্টলের পাইলট প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে। প্রথমে দেশের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রিন্সিপাল ব্রাঞ্চে, দেশের কয়েকটি বড় বাণিজ্যিক ব্যাংকে এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে এলটিইউ কিছুদিন আগে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তাদের ভ্যাট আদায়ের সব কাগজপত্র ও তালিকা তলব করে। এতে এলটিইউ দেখতে পায় দেশের থমসন রয়টাসর্ সফটওয়্যার সুবিধাপ্রাপ্ত ১৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ১৫টি ব্যাংক তথ্যপ্রযুক্তির এই সেবা দিচ্ছে। পরে এলটিইউ মোট ১১টি ব্যাংকের কাছ থেকে এই তথ্যগুলো আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। সেখানে দেখা যায় মাত্র একটি ব্যাংক শুধু ৫০ লাখ টাকা ভ্যাট জমা দিয়েছে! ফলে এলটিইউ কমর্কতার্রা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশের এই সেবায় জড়িত সব ব্যাংকের তথ্যাদি তারা নিরীক্ষণ করবেন। এলটিইউর আওতাধীন ব্যাংকগুলো হলো- সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, উত্তরা, প্রাইম, স্ট্যান্ডাডর্ চাটার্ডর্, ন্যাশনাল, ব্র্যাক, ইসলামী, এবি, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ বাংলা, প্রিমিয়ার, ব্যাংক এশিয়া, এইচএসবিসি ও সাউথইস্ট ব্যাংক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলটিইউর এক কমর্কতার্ বলেন, শুরুর দিকে ব্যাংকগুলোকে এই সফটওয়্যার ব্যবহারের কথা বলা হলে তারা অনেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। কিন্তু রাজস্ব বোডের্র চাপে এখন তারা সবাই এটি ব্যবহারে সম্মত। এটি কাযর্কর হলে সরকার বিরাট অংকের ভ্যাট হাতে পাবে বলে আশা করেন ওই কমর্কতার্। তিনি আরও বলেন, এলটিইউ প্রাথমিকভাবে ব্যাংকগুলোতে এই প্রযুক্তির সফটওয়্যার ব্যবহার করছে কর আদায় ঠিক মতো হচ্ছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য। স্বাভাবিকভাবে এটি সহজ হলে দেশের বাকি ব্যাংকগুলোতেও পযার্য়ক্রমে এই সফটওয়্যার বসানো হবে। গত ৭ জুন সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক খাতের করপোরেট করহার কমানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন অথর্মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর আগের অথর্বছরে এই করহার ছিল ৪০ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে তা আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ নিধার্রণ করা হয়েছে। মূলত বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে এ প্রস্তাব করেন তিনি। আথির্ক খাতে কর কাঠামোতে সমতা আনতে একই কর সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে লিজিং, বিমা ও মাচের্ন্ট ব্যাংকের জন্য। তবে অন্যান্য খাতের করপোরেট কর অপরিবতির্ত রাখা হয়েছে। এ প্রস্তাব কাযর্কর হলে ব্যাংকসহ আথির্ক প্রতিষ্ঠানগুলো বাষির্ক যে পরিমাণ মুনাফা করে, তার ওপর সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে কর দেবে সরকারকে। এতে করের চাপ কমবে। তাদের বাড়তি মুনাফা হবে। বাড়বে মূলধন। করপোরেট করের মধ্যে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণ হয়। মোট করপোরেট করের ৭০ শতাংশ আয় হয় এখাত থেকে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আড়াই শতাংশ করহার কমানোর ফলে ব্যাংক খাত থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আয় হবে সরকারের। চলতি অথর্বছরে ব্যাংক খাত থেকে করপোরেট কর বাবদ আদায় হবে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অথর্বছরে এ খাত থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। অথর্নীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংকসহ আথির্ক খাতের করপোরেট করহার কমলে একদিকে কর কাঠামোর বিরাজমান বৈষম্য নিরসন হবে, পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অপরদিকে ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকের করহার কমালে ব্যাংকগুলোর মুনাফা বাড়বে। এতে মূলধন (ক্যাপিটাল) বাড়বে। এর প্রভাবে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। এদিকে শুধু ব্যাংকে নয়, বাংলাদেশের রাজস্ব বোডর্ বলছে, ভ্যাট আদায়ে ফঁাকি রোধে খুব শিগগিরই সারা দেশে ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস বা ইএফডি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। দেশে গত পঁাচ বছরে যত রাজস্ব আহরিত হয়েছে তার প্রায় ৭৫ ভাগই এসেছে ভ্যাট আর আয়কর থেকে। যদিও ভ্যাটের আওতা ক্রমশ: বাড়ানো নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে, আবার ভ্যাট ফঁাকি দেয়ার ব্যাপক প্রবণতাও রয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। নতুন অথর্বছরেও ভ্যাটে প্রায় এক লাখ কোটি ও আয়কর খাতে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নিধার্রণ করা হয়েছে। ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়া বা পদ্ধতিগত দুবর্লতার কথা স্বীকার করেই রাজস্ব বোডের্র চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেছেন খুব দ্রæতই ইলেকট্রনিক লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত করবেন তারা। সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেন ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস ক্রয় করে সেটি বাধ্যতামূলক করা হবে। এগুলো এনবিআরের কেন্দ্রীয় তথ্য ভাÐারের সাথে সংযুক্ত থাকবে। তা হলে ভ্যাট ফঁাকি দেয়ার সুযোগ থাকবে না। পাশাপাশি উপজেলা পযার্য় পযর্ন্ত বিত্তশালীদের এবং যারা স্থানীয় সরকার পযাের্য় যারা নিবার্চনে অংশ নিয়ে থাকেন তাদের কিভাবে করের আওতায় আনা যায়- তা নিজেও কাজ চলছে বলে জানান জাতীয় রাজস্ব বোডের্র চেয়ারম্যান।