নতুন মজুরির অজুহাতে চলছে শ্রমিক ছাঁটাই

জ্জ প্রায় ৩০ শতাংশ হেলপার কমিয়ে দেয়া হয়েছে জ্জ ন্যায্য মূল্য আদায়ে মাঠে নেমেছেন গার্মেন্ট মালিকরা

প্রকাশ | ১৩ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

ইমদাদ হোসাইন
গত ১০ বছরে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ৩৮১ শতাংশ মজুরি বেড়েছে। নিরাপদ কারখানা বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে কোটি কোটি টাকা। কিন্তু ক্রেতারা পণ্যে সঠিক মূল্য দেয়নি। ফলে নতুন মজুরি বাস্তবায়ন করতে ২০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হেলাপার (৭ গ্রেডের শ্রমিক) ছাঁটাই করতে হচ্ছে কারখানাগুলোকে। কয়েকটি কারখানার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এমন তথ্য। তারা জানিয়েছেন, স্থায়ী সমাধানের জন্য ক্রেতাদের সামাজিকভাবে চাপে রাখতে চান তারা। দর কষাকষিতেও আনতে যাচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। এজন্য ইউরোপের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করে যাচ্ছেন তারা। আর তাদের সহায়তা করছে নেদারল্যান্ডস সরকার ও ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পোশাক কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ী নেতা জানান, নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের পর তিনি যখন খরচ মেটাতে ব্যর্থ হন তখন তার কারখানার প্রতি ২০ জন হেলপার থেকে ১৫ জনকে সাটাই করেছেন। একইসাথে তিনি তার কারখানার কর্মরত শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছেন। কমিয়ে দিয়েছেন ওভারটাইম। তবে এটা সাময়িক সমাধান। আইন অনুযায়ী আগামী বছর আবারো ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়বে। তাই এখন থেকেই ন্যায্য মূল্য আদায়ে ক্রেতাদের চাপ দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। ইউরোটেক্স নামক এক পোশাক কারখানার বিকেএমইএর প্রতিনিধি জানান, নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন হওয়ার পর তারা অনেকটা সঙ্কটের মধ্যে পরে। এই সমস্যা সমাধানে ওভার টাইম বন্ধ করে দেয়। প্রায় ৩০ শতাংশ হেলপার কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এর পরেও শ্রমিকের বেতন দিতে তাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) এক তথ্য অনুযায়ী,  ২০১৩ সালে এক ডজন পণ্যে ক্রেতারা যেখানে ৬২ দশমিক ২৬ ডলার দাম দিত ২০১৭ সালে ক্রেতারা ওই একই পণ্যের মূল্য দিচ্ছে ৫৬ দশমিক ৭০ ডলার। অথচ এই সময়ে প্রতি বছর কারখানাগুলোতে কেবল শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে ৫ শতাংশ হারে। এছাড়া দেশের সকল কারখানা নিরাপদ করতে কোটি টাকা খরচ করেছে। তৈরি হয়েছে অনেক পরিবেশ বান্ধব গ্রিন কারখানা। বিকেএমইএর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১ থেকে ৭ গ্রেডের ৮শ' শ্রমিক কাজ করে এমন একটি কারখানায় একটি বেসিক টি-শার্ট তৈরি করতে একজন শ্রমিকের গড়ে ৬ কর্ম মিনিট সময় লাগে। ২০১৩ সালে একজন শ্রমিকের সর্বনিম্ম মজুরি ছিল ৫৩০০ টাকা। আর এতে উৎপাদন খরচের প্রয়োজন হতো দশমিক ১৮৪৮ মার্কিনডলার। কিন্তু ২০১৮ সালের নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের পর এখন সর্বনিম্ন মজুরি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার টাকা আর একই টি-শার্ট তৈরি করতে খরচ হচ্ছে দশমিক ২৫৫০ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ প্রতিটি টি-শার্ট তৈরিতে খরচ বেড়েছে ৭ সেন্ট। অথচ এই সময়ের মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ ক্রেতা তার পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিটি বেসিক টি শার্টের গড় এফওবি মূল্য ৩ দশমিক ৫০ ডলার। এর মধ্যে সুইং বাবদ প্রতি ডজনে কারখানাগুলোকে দেয়া হয় ৮ থেকে ১৪ ডলার। প্রতিটি টি-শার্টের সুইং গড় মূল্য ১ ডলার ধরলে সেখানে সরাসরি শ্রমিক পাচ্ছে মাত্র ০ দশমিক ৩৩ ডলার। আর পরোক্ষভাবে কাজ করে এমন শ্রমিকরা পাচ্ছে ০ দশমিক ৩৮ ডলার। অর্থাৎ শ্রমিক পাচ্ছে ০ দশমিক ৭১ মার্কিন ডলার। আর কারখানার আনুষঙ্গিক খরচ বাবাদ  পাচ্ছে ০ দশমিক ২৯ ডলার। তবে কারখানার মালিককে লাভ হিসেবে কোনো অর্থ দেয়া হয় না। শ্রমিকের মজুরির জন্য বরাদ্ধ অংশ থেকেই কারখানার মালিক যতটুকু লাভ করতে পারে। অর্থাৎ সেখানেও প্রতারিত হচ্ছে শ্রমিক। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি পিস বেসিক টি-শার্টের ভোক্তা পর্যায়ের মূল্য থেকে মাত্র ২ দশমিক ৯৫ শতাংশ পায় শ্রমিক। আর মোট লাভের মাত্র ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ মজুরি পায় পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। শ্রমিক সাটাইয়ের বিষয়টি স্বীকার করে বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলে শামিম এহসান বলেন, এতদিন ক্রেতারা সামাজিকভাবে চাপ দিয়ে আমাদের কর্মপরিবেশের উন্নতি করেছে। আমরাও শ্রমিকের ভালো চাই। কারণ তারাই আমাদের আপনজন। আমরা তাদের নূ্যনতম মজুরি নয় উন্নত বেতন দিতে চাই। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ক্রেতারা আমাদের ন্যায্য মূল্য দেয়নি। কারখানাগুলো লোকশান দিতে দিতে অনেকেই বন্ধ করে দিয়েছে। এখন সময় এসেছে আমাদেরও সামাজিকভাবে তাদের চাপ দিয়ে দরকষাকষির মাধ্যমে পোশাকের ন্যায্য মূল্য আদায় করার। একইসাথে নিজেদের শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির সমন্বয় করতে হবে। যদিও আমরা ব্যাংক থেকে সহজে আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছি না। ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ ও মায়ানমারবিষয়ক কান্ট্রি ম্যানেজার কয়েন অস্টিরম বলেন, লোকশান এড়াতে শ্রমিক ছাটাই কোনো সঠিক সমাধান নয়। বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে উৎপাদন খরচ ও মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ক্রেতারা মূল্য বাড়ায়নি। এটা দুখজনক। এছাড়া কারখানার মালিকরাও সঠিক পদ্দতিতে ক্রেতাদের কাছে মজুরি বৃদ্ধির দাবি করতে পারেনি। আমরা তাদের আধুনিক প্রযুক্তিতে সঠিক দাম নির্ণয়ে সহায়তা করব। একই সাথে পোশাকের ন্যায্য পাওনা আদায়ে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলব।