খেলাপি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্ত

ম 'অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি' খোলার চিন্তা ম এ ধরনের কোম্পানির মাধ্যমে সাতটি দেশ তাদের বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। সাতটি হলো- ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান এবং ফিলিপাইন।

প্রকাশ | ২১ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ইমদাদ হোসাইন বেসামাল খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে 'অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি' খোলার চিন্তা করছে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল এ খাতকে শক্তিশালী করার প্রয়াস হিসেবে এই উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুই মাস আগে ৬ সদস্যের কমিটির বৈঠকের সুপারিশের অংশ হিসেবে তারা এ সিদ্ধান্তে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের সময় কিভাবে তাদের বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করেছে, তার বিস্তর বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণও সেভাবে নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা করেছে ওই ছয় সদস্যের কমিটি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছে, সাতটি দেশ তাদের বিশলা অংকের শ্রেণিকৃত ঋণ বা খেলাপি ঋণ খুব সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিল। এই সাতটি দেশের মধ্যে রয়েছে- ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান এবং ফিলিপাইন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছয় সদস্যের কমিটির একজন জানান, ওই দেশগুলোর মধ্যে এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তে ইন্দোনেশিয়ার খেলাপি ঋণের অবস্থা ছিলো ভয়াবহ। তখন দেশটির ব্যাংক খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৫০ শতাংশই ছিল খেলাপি। কিন্তু ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ দেশটির খেলাপি ঋণ কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশে। তিনি জানান, ইন্দোনেশিয়াকে একটি উদাহরণ হিসেবে নিয়ে কমিটি নতুন একটি কোম্পানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি হলে খেলাপি ঋণকে একটি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। কোম্পানির কাজ হবে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এনপিএল কিনে এনে ব্যক্তি পর্যায়ে বা করপোরেট পর্যায়ে তার বিতরণ করা। ওই কমিটির তৈরি করা প্রতিবেদনে দেখা যায়, কোম্পানির কাজ হবে নির্দিষ্ট বন্ডের বিনিময়ে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এনপিএল নিয়ে নেয়া। এটি নির্দিষ্ট ম্যাচিউরিটি পর্যন্ত হবে। ফলে ঋণ প্রদানকারীরা মন্দ ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট সঞ্চিতি রাখতে সক্ষম হবে। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, কমিটি এনপিএলের জন্য আরেকটি সেকেন্ডারি মার্কেট তৈরির সুপারিশ করেছে। যেখানে খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ কিনতে কিংবা বিক্রি করতে পারবে। একটি অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানিকে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে একটি সেকেন্ডারি মার্কেট খুব বেশি প্রয়োজন। ফলে বন্ডের ইকুইটি আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। কমিটির সুপারিশ করে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন বু্যরোর (সিআইবি) মতো করে সুযোগ সুবিধা নিয়ে এনপিএল নিয়ে আরেকটি ডাটা ওয়্যারহাউজ খোলা দরকার। আর অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানি থেকে যারা ডিফল্ট লোনের কেনা-বেচায় অংশ নেবে তাদেরকে কর ছাড়ের সুবিধা দেয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রমতে, অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানি খোলার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছয় সদস্যের কমিটির ওই সুপারিশ ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রহিম ও যুগ্ম পরিচালক মো. আশিকুর রহমান ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, চিহ্নিত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়ার বদলে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন ঋণখেলাপিদের ক্ষেত্রে সরকারের এক ধরনের শিথিলতা। এটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সময় ২০১৬ সালে ডেট রিকভারি এজেন্ট কোম্পানি গঠনের উদ্যোগ ছিল, সেটি আলোর মুখ দেখেনি। ওই সময় আইনের খসড়াও প্রণয়ন করা হয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তানে এজেন্ট থাকার তথ্য তুলে ধরে কোম্পানি গঠনের বদলে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় ঋণ আদায়ে এজেন্ট নিয়োগের পক্ষে মত দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে উল্টো মত দেয় সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক। সে পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানি গঠনের বদলে এজেন্ট নিয়োগ দিতে একটি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ তখনই নেয়া হয়েছিল, যা পরে আর এগোয়নি। এখন ব্যাংকাররা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করে ঋণ আদায়ে সফলতা আসতে পারে। খেলাপি ঋণ আদায়ে অন্যান্য দেশে গঠিত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো ব্যাংক যেসব খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারে না, সেগুলো কম টাকায় কিনে নেয়। আলোচনা করে আদায় করতে না পারলে কোম্পানি খেলাপির বিরুদ্ধে মামলা করে আদায় করে থাকে। কোনো কোনো দেশে সম্পূর্ণ বেসরকারি মালিকানায় এ ধরনের কোম্পানি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অর্থঋণ আদালতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলার সংখ্যা ৫৭ হাজার ৪১৬। তাতে আটকে আছে এক লাখ ১০ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। উচ্চ আদালতে ৫ হাজার ৩৭৬টি রিটে আটকে আছে ৫২ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গত ৩১ ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। এরমধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ৬ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৮ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, বিডিবিএলের ৮৮৭ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৮ হাজার ৬৩১ কোটি, জনতা ব্যাংকের ১৭ হাজার ২২৫ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ১৪২ কোটি এবং সোনালী ব্যাংকের ১২ হাজার ৬১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ২১৮ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশি এই আট ব্যাংকে।