বছরের ব্যবধানে রপ্তানি কমেছে ১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ

উল্টো রথে 'সাদা সোনা' রপ্তানি

প্রকাশ | ১১ মে ২০১৯, ০০:০০

ইমদাদ হোসাইন
বাংলাদেশের সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি রপ্তানি দিনে দিনে উল্টো রথে হাঁটছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও চিংড়ি রপ্তানি ছিল ৪৪ কোটি ৬০ লাখ ডলারের। অথচ চলতি অর্থবছরের গত ১০ মাসে 'সাদা সোনা'র রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৩১ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের। গত বছরের একই সময়ে এ পণ্যের রপ্তানি ছিল ৩৫ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে এ খাতে রপ্তানি আয় কমেছে ১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য এটি। সংস্থাটির দেয়া তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের চিংড়ি রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্র ছিল ৪০ কোটি ডলারের। প্রথম দশ মাসে কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩২ কোটি ৭২ লাখ ডলারের। এর বিপরীতে দশমাসে আয় হয়েছে মাত্র ৩১ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের। অর্থাৎ এই সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৭০ শতাংশ পিছিয়ে আছে এই খাত। গত বছরের (২০১৭-১৮) একই সময়ে এই পণ্যের রপ্তানি ছিলো ৩৫ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে এ খাতে রপ্তানি আয় কমেছে ১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৪০ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। কিন্তু এবছর এখাতের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে চিংড়িকে বলা হয় সাদা সোনা। আন্তর্জাতিক বাজারে অসম প্রতিযোগিতা ও দেশের বাজারে উৎপাদন কমাসহ বিভিন্ন সংকটে পড়েছে দেশের চিংড়ি রপ্তানি বাজার। এর ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে সাদা সোনা বা হোয়াউট গোল্ড খ্যাত এ পন্যের রপ্তানি আয়। চিংড়ি রপ্তানি আয় কমার পেছনে সংশ্লিষ্টরা আন্তর্জাতিক বাজারের অসম প্রতিযোগিতাকেই বেশি দায়ি করেন। প্রতিযোগী দেশগুলো কম দামের চিংড়ি বেশি উৎপাদন করছে আর কম দামে বাজারে সরবরাহ করছে। যেহেতু বাংলাদেশের গলদা ও বাগদা চিংড়ি ব্যাপক হারে চাষ হয়। উন্নত মানের এ চিংড়ির দামও বেশি। তাই দেশের চিংড়ির বাজার হুমকির মুখে পড়ছে। অপরদিকে, প্রতিযোগী দেশ ভারত ও ভিয়েতনাম বিকল্প জাত ভেনামি চিংড়ি চাষ করে। বাগদা চিংড়ির তুলনায় ভেনামি চিংড়ির দাম অনেক কম এবং উৎপাদন বেশি হয়। বাগদা চিংড়ির চেয়ে ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম হয়। রপ্তানিতেও পাউন্ডে দুই ডলার কম হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা ভেনামি চিংড়ির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আর বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনে অনুমতিও নেই। আবার সেমি ইনসেন্টিভ প্রযুক্তিতে যে চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই মারা যাচ্ছে আবহাওয়ার কারণে। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওজনে বেশি দেখানোর জন্য চিংড়িতে অপদ্রব্য ঢুকিয়ে (পুশ) রপ্তানি করে যা দেশের বাজার নষ্ট করছে। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৪ কোটি ৬০ লাখ ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক, শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ২০ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। সামগ্রিকভাবে চিংড়ি রপ্তানি বাড়লেও যুক্তরাজ্যে কমেছে। গত অর্থবছর দেশটিতে ৮ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের চিংড়ি। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৭০৬ টন চিংড়ি রপ্তানি করে ৪৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার আয় হয়। আর সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতের আয় আরও ৪ কোটি ডলার কমে যায়। ৪০ কোটি ৪৭ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৫ কোটি ডলারের চিংড়ি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলেও ঘাটতি থেকে যায় ৯.১৮ শতাংশ। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) তথ্য মতে, গত চার বছরের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির হার ক্রমাগত কমছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ৬৩৫ টন চিংড়ি রপ্তানি করে ৫৫ কোটি ডলার আয় হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৪ হাজার ২৭৮ টন চিংড়ির বিপরীতে আয় হয় ৫১ কোটি ডলার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪০ হাজার ২৭৬ টন চিংড়ি থেকে আয় আসে ৪৫ কোটি ডলার। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে গেল চার বছর ধরে চিংড়ির রপ্তানি কমছে। চিংড়ি উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানি পর্যন্ত আট থেকে ১০ ধাপ পার হতে হয়। এতে মাঠের চাষীরা দাম পায় অনেক কম। এছাড়া চিংড়ি রপ্তানিকারকদের নিয়েও চাষীদের আছে নানা অভিযোগের জায়গা। বছরের প্রায় তিন মাস সমুদ্রে মা চিংড়ি আহরণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় হ্যাচারিগুলো মা চিংড়ি পাচ্ছে না। চাষিদের কাছেও প্রয়োজনমত চিংড়ি পোনা পৌঁছায় না। তাই উৎপাদন কমে গেছে অনেকাংশে। কিন্তু এ খাতকে ধরে রাখতে হলে বা আগের অবস্থান ফিরে পেতে হলে রপ্তানি বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি বাড়াতে হবে উৎপাদনও। চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রপ্তানি হওয়া গলদা চিংড়ির ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাজ্য। তবে ব্রেক্সিটের কারণে দেশটিতে এখন মন্দাবস্থা চলছে। তাই চিংড়ির চাহিদাও গেছে কমে। তবে দেশে প্রতিবছরই গলদার উৎপাদন বাড়ছে। একদিকে রপ্তানিতে মন্দা অন্যদিকে উৎপাদন বৃদ্ধি তার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারে। কমছে দাম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে চাষিরা গলদা চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। বাগেরহাটের বিভিন্ন আড়তে বড় আকারের বা ৫ গ্রেডের প্রতি কেজি গলদা ৭৪০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হয়। পাঁচ মাস আগে এ দাম ছিল ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা। ছোট আকারের বা ১০ গ্রেডের গলদা ৭০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ মাস এই গ্রেডের দাম ছিল ৯৫০ টাকা। এ ছাড়া ২০ ও ৩০ গ্রেডের বা সবচেয়ে ছোট আকারের গলদা বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ থেকে ৪২০ টাকার মধ্যে। লবণ পানির বাগদার চেয়ে মিষ্টি পানির গলদা চাষে ঝুঁকি কম। তাই প্রতিবছরই গলদার উৎপাদন বাড়ছে। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ৪২ হাজার ৫৩ মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি উৎপাদিত হয়। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪৬ হাজার ১৮৯ মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি উৎপাদিত হয়। আর সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে ৪৮ হাজার ৫৭৪ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। ইপিবি বলছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বব্যাপী চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে ৫০ কোটি ৯০ লাখ ডলারের। এর মধ্যে রাশিয়ায় রপ্তানি হয় ১ কোটি ৯৩ ডলারের। আগের অর্থবছরে ৪৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়। এর মধ্যে রাশিয়ায় গেছে ২ কোটি ৭৯ লাখ ডলার মূল্যের চিংড়ি। রপ্তানিকারক সমিতি বলছে, এ দেশ থেকে ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে চিংড়ি রপ্তানি করে। রাশিয়ায় চিংড়ি রপ্তানি করতে হলে সে দেশের ভেটেরিনারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। রপ্তানিকারক সমিতির তথ্যমতে, দেশে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে বাগদা ও গলদাসহ মাত্র পাঁচ প্রজাতির চিংড়ি চাষ করা সম্ভব হয়। চাষ থেকে যত চিংড়ি উৎপাদিত হয় এক মৌসুমে, তার চেয়ে বেশি চিংড়ি পাওয়া য়ায় প্রাকৃতিক উৎস থেকে। এই দু'উৎস মিলে এক মৌসুমে দেশে ৩ লক্ষ টন চিংড়ি পাওয়া যায়। যার চার ভাগের এক ভাগ রপ্তানি হয় বাকিটা দেশের ভেতরেই বিক্রি হয়। চিংড়ির রপ্তানি বাণিজ্য মন্দা যাচ্ছে দেশের জন্য বিগত কয়েক বছর ধরে। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চাষেও। উপকূলের জেলা সাতক্ষীরাকে বাগদা চিংড়ির রাজধানী বলে চাষীরা। চাষের বাগদা বিক্রি করতে সাতক্ষীরার পাইকগাছায় এমানি করেই নিলামের ডাক উঠে সকাল সন্ধ্যা। সূর্য উঠার আগেই চিংড়ি চাষের নানা ঘের থেকে চাষীরা বিক্রিযোগ্য বাগদা নিয়ে আসে এই বাজারে। কয়েক দশকের রমরমা এই বাণিজ্যে যুক্ত চাষীদের চেহারা গেলও কয়েক বছর ধরে মলিন। চিংড়ি চাষ ও বাণিজ্যের সাথে দেশের প্রায় অর্ধকোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এই চাষের সবচেয়ে বড় উৎসাহ বা প্রণোদনার জায়গা বিদেশে চিংড়ি রপ্তানি। ঘের থেকে চিংড়ি উঠানোর পর দশ বারো হাত ঘুরে বিদেশের বাজারে যায় দেশের চিংড়ি। এ ক্ষেত্রে মাঠের চাষীরা লাভের সবচেয়ে কম অংশটি পায়। তবু রপ্তানির জৌলুসটাই তাদের উদ্বুদ্ধ করে। অথচ সেই রপ্তানির চিত্রও গেলও কয়েক বছর ধরে উৎসাহ ব্যঞ্জক নয়। চিংড়ি রপ্তানিকারকদের নিয়ে চাষীদের আছে নানান সমালোচনা ও অভিযোগের জায়গা। যা নিয়ে পাল্টা বক্তব্যও আছে অভিযুক্তদের। চিংড়ি চাষ নানান কারণে খুব স্পর্শকাতর। প্রাকৃতিক দূর্যোগ, নানা রোগের আক্রমনসহ বিভিন্ন বিপদ আপদ ও সীমাবদ্ধতা চিংড়ি চাষীদের দুঃখের জায়গা। চিংড়ি চাষের সংগ্রামটা বরাবরই ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিংড়ির বৈদেশিক বাণিজ্যে মন্দা যাবার কারণে সংগ্রামটা এখন একটু বেশি। তবুও চাষীরা দিন ফিরবার আশায় এখনই চিংড়ি চাষ থেকে মুখ ফিরাতে আগ্রহী নয়। বাগদা, গলদাসহ মাত্র পাঁচ প্রজাতির চিংড়ি চাষ করা হয় দেশে। প্রকৃতি ও চাষ এ দুই উৎস থেকে এক মৌসুমেই প্রায় ৩ লাখ টন চিংড়ি পাওয়া যায়। যার চার ভাগের এক ভাগ রপ্তানি হয় আর বাকিটা দেশের চাহিদা পূরণ করে। উৎপাদিত চিংড়ি যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য ও বেলজিয়ামে রপ্তানি হয়। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় বেলজিয়ামে।