আমদানি নির্ভরতায় হুমকিতে দেশীয় সুতা

প্রকাশ | ১৯ মে ২০১৯, ০০:০০

ইমদাদ হোসাইন
গত বছরও সুতা আমদানিতে বিশ্বের এক নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। ওই বছর মোট সুতা আমদানির ২৬ দশমিক ১২ শতাংশই এসেছে ভারত থেকে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্যানুযায়ী, আমদানি নির্ভরতা বাড়ায় দেশের সুতাশিল্পে এখনো ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সুতা অবিক্রীত অবস্থায় আছে। এতে হুমকির সম্মুখীন দেশীয় সুতাশিল্প। ইউনাইটেড স্টেট ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ খুবই কম দামে চীন থেকে সুতা ও কাপড় আমদানি করতে পারছে। চীন তাদের মোট সুতা রপ্তানির ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাংলাদেশে পাঠায়। রপ্তানিকারকদের সরাসরি ক্যাশ রিটার্নও দিচ্ছে চীন। মার্চে আন্তর্জাতিক বাজারে কাপড় ও সুতার দাম কমে যাওয়ায় চীন, ভারত ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে সুতা আমদানির পরিমাণ বেড়ে যায়। ইউএসডিএ আরও জানায়, খুব বেশি আমদানির ফলে বাংলাদেশের স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলো অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হুমকির সম্মুখীন রয়েছে। বাংলাদেশের ইমপোর্ট ডিউটির ৩২ দশমিক হাতে তৈরি সুতা, ৯১ দশমিক ৩৭ শতাংশ কাপড়, ৩৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ সুতা এবং টেক্সটাইল খাতের ডাইং কেমিক্যাল ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ। ফাস্ট ফরোয়ার্ডের ২০১৮ সালের হিসেব মতে, বিশ্বের এক নম্বর তুলা আমদানিকারক দেশ বাংলাদেশ। আগে এই তালিকার শীর্ষে ছিল চীন। এক দশক আগেও বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় কাপড়ের বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। এখন দেশের কারখানায় তৈরি কাপড়ই নিজেদের চাহিদা পূরণ করছে। আর এই কাপড় তৈরি করতে যে পরিমাণ তুলা দরকার তার ৯৭ শতাংশ বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। মূলত ভারত, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে আসে এই তুলা। বিটিএমএর তথ্যমতে, বাংলাদেশে এখন ৪০৩টি স্পিনিং মিল, ৮০২টি বুনন শিল্প, ২৪৪টি ডাই কারখানা, ৩২টি ডেনিম ফেব্রিক মিল, ২২টি হোম টেক্সটাইল মিল রয়েছে। আর দেশে সব মিলিয়ে ৬ হাজার ৫০২টি নিবন্ধিত এবং ৫২৭টি অনিবন্ধিত গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে। জানা গেছে, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক উৎপাদনে ব্যবহার করা সুতা কিংবা কাপড় আমদানিতে কোনো ধরনের শুল্ক দিতে হয় না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে বন্ড লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোই শুল্কমুক্ত এই আমদানির সুবিধা পায়। এর বাইরে দেশীয় বাজারের জন্য বাণিজ্যিক উদ্দেশে সুতা-কাপড় আমদানিতে গড়ে ৬২ শতাংশ শুল্কারোপ রয়েছে। বন্ড লাইসেন্স অপব্যবহারের মাধ্যমে এই পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাজার দখলে নিয়েছে অবৈধ সুতা এবং কাপড়। এতে একদিকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে দেশীয় বস্ত্রশিল্প। বিটিএমএ সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদিত সুতা-কাপড় অবিক্রীত পড়ে আছে গুদামে। অবিক্রীত এই দুই পণ্যের দাম অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলার কারণে বাধ্য হয়ে এখন উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে সুতা-কাপড় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। উদ্যেক্তারা তাদের মিলের সক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার করছেন। সাধারণত স্থানীয় বাজারের জন্য ঈদের আগের তিন মাসকে ভরা মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। আসছে ঈদ সামনে রেখে এ অবস্থা এখন চরম আকার নিয়েছে। ফলে বিদেশি অবৈধ সুতা-কাপড়ের দাপটে মার খাচ্ছে দেশীয় তাঁত ও বস্ত্রশিল্প। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাজেটে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত সুতা খোলাবাজারে বিক্রি ঠেকাতে বিশেষ ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে আসছে বিটিএমএ। রপ্তানিমুখী পোশাক উৎপাদনে প্রয়োজনীয় বস্ত্রের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ১৭ কোটি মানুষের বস্ত্রের চাহিদা পূরণ করে আসছে বিটিএমএর কারখানাগুলো। জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উদ্যোক্তা বলেন, শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার অপব্যবহারের কারণে দেশে এক লাখের মতো তাঁতের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ এখন বন্ধ। রপ্তানিমুখী সুতা এবং কাপড় উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত মিলগুলোও চোরাইপথে আমদানি করা সুতার কারসাজিতে বিপদে পড়েছে। এসব কারণে উৎপাদন ক্ষমতার ৬০ শতাংশ কমিয়ে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্ট মিলগুলো। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাজেটে নতুন করে সুতা আমদানিতে শুল্কারোপের দাবি সংশ্লিষ্টদের। একই সঙ্গে বন্ডেড সুতা খোলাবাজারে বিক্রি ঠেকাতে এনবিআরকে আরো কঠোর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তারা। অন্যদিকে বাংলাদেশে মানহীন সুতা পাঠানো ও ওজনে কম দেয়ায় ভারতের সুতার বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বাংলাদেশের আমদানিকারকরা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ভারতীয় সুতার মান খুবই খারাপ হওয়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য যুদ্ধে লাভবান বাংলাদেশের পোশাক ব্যবসায়ীরা। চীনের কাপড় ও সুতা সস্তায় পাচ্ছেন তারা। বিটিএমএর তথ্যমতে, পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার সাদা সুতায় বাংলাদেশের আকর্ষণ বেশি। শুধু আফ্রিকা থেকেই এ বছর ৩৭.০৬ শতাংশ সুতা আমদানি হয়েছে এদেশের পোশাক শিল্পের জন্য। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো থেকে এসেছে ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর বাকি ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ এসেছে বিশ্বের বাকি সুতা রপ্তানিকারক দেশগুলো থেকে। বিটিএমএর একজন নেতা জানান, ভারতীয় সুতার মান কমে যাওয়ায় সে দেশ থেকে সুতা আমদানি কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সময়মতো শিপমেন্ট করতে পারেন না। চুক্তি অনুযায়ী, চাহিদা মতো সুতাও দিতে পারেন না তারা। উদাহরণ হিসেবে ওই নেতা জানান, বাংলাদেশে ভারত থেকে সুতা আসার পর দেখা যায় চুক্তিপত্রের লিখিত চাহিদার চেয়ে ওজনে ৩ থেকে ৪ শতাংশ কম থাকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমও থাকে সেখানে। এটি আমদানিকারকদের জন্য খুব বড় ধরনের ক্ষতি। ভারতীয় সুতায় এমনিতেই মান খারাপ তার ওপর এসব ঘটনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে ব্যবসায়ীদের মাঝে।