ঋণ-আমানত সুদ হারের ব্যবধান

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার তোয়াক্কা করছে না ১১ ব্যাংক

প্রকাশ | ২৪ মে ২০১৯, ০০:০০

ইমদাদ হোসাইন
ঋণের উচ্চ সুদহার দেশের বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো নিজের ইচ্ছামতো সুদহার নিয়ন্ত্রণ করছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ঋণের এ উচ্চ সুদহার কমিয়ে আনতে ব্যাংকগুলোকে তাগাদা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকে আমানতকারীদের স্বার্থ সুরায় আমানতের সুদহার যুক্তিসঙ্গত মাত্রায় রাখার নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার তোয়াক্কা করছে না দেশি-বিদেশি ব্যাংকগুলো। জানা গেছে, ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে কয়েক দফায় নির্দেশনাও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অথচ স্প্রেড কমার বদলে বাড়িয়েই চলছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানছে না বেসরকারি ও বিদেশি ১১টি ব্যাংক। ঋণ ও আমানতের সুদের ব্যবধানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ভঙ্গ করছে ব্যাংকগুলো। আমানতের বিপরীতে কম সুদ বিতরণ করে ঋণের বিপরীতে বেশি সুদ আদায়ের তালিকার শীর্ষে রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির আমানতের সুদহার ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ বিপরীতে ঋণের সুদহার ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। স্প্রেড গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩১ শতাংশে। তার পরেই রয়েছে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) ৫ শতাংশের ওপরে থাকা বিদেশি ব্যাংকগুলো হলো- স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, সিটি ব্যাংক এনএ, উরি ব্যাংক, এইচএসবিসি এবং ব্যাংক আল-ফালাহ। বেসরকারি ব্যাংকগুলো হলো- আইএফআইসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক, ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে, স্প্রেড পাঁচ শতাংশের নিচে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার নির্দেশনা দিয়ে আসছে। কিন্তু তা মানছে না বেশ কয়েকটি ব্যাংক। আমানতকারীদের স্বার্থক্ষার জন্য আমানতের সুদের হার বেশি রাখতে হবে। যদিও মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাংকগুলো নিজস্ব নীতিমালার আলোকে ঋণ ও আমানতে সুদহার নির্ধারণ করতে পারে। ব্যাংকিং খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ব্যাংকের কাছে প্রচুর পরিমাণে অলস টাকা পড়ে আছে। বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে না। আবার খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়ছে। এত কিছুর পরও বছর শেষে রয়েছে ভালো মুনাফা অর্জন করার টার্গেট। ফলে আমানতকারীদের দিকে খেয়াল না রেখেই বছর শেষে ভালো মুনাফা অর্জনের স্বার্থে আমানতের সুদ কমাচ্ছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদেশি খাতের ৪টি ব্যাংকের স্প্রেড ৬ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপরে অবস্থান করছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাস শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোর ঋণের ক্ষেত্রে ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ হারে সুদ আদায় করেছে। আমানতের বিপরীতে দিয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৩১ শতাংশ। এতে গড় স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের ৫ ব্যাংকের স্প্রেড পাঁচ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপর অবস্থান করছে। গত এপ্রিল মাস শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণের ক্ষেত্রে গড়ে ১০ দশমকি ২৫ শতাংশ হারে সুদ আদায় করেছে। আমানতের বিপরীতে দিয়েছে ৬.০৪ শতাংশ সুদ, স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২১ শতাংশীয় পয়েন্ট। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য হালনাগাদ করে দেখা যায়, গত এপ্রিল পর্যন্ত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের স্প্রেড সবচেয়ে বেশি। ব্যাংকটির ঋণের সুদহার ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ, বিপরীতে আমানতের সুদহার ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ব্যাংকটির স্প্রেড গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। উচ্চহারের স্প্রেডে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকটির ঋণের সুদহার ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, বিপরীতে ব্যাংকটির আমানতের সুদহার ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ।। ব্যাংকটির স্প্রেড গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৭.০৯ শতাংশ। এছাড়া আইএফআইসি ব্যাংকের ৫.০২, প্রাইম ব্যাংকের ৫.০৯ এবং এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের স্প্রেড গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েক বছরের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ধীরে ধীরে কমছে আমানতের সুদহার। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানতের গড় সুদের হার ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানতের গড় সুদের হার ছিল ৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আর এর আগের বছর ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে ব্যাংক আমানতের গড় সুদহার ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানতের গড় সুদের হার ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছর শেষে ব্যাংক আমানতের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ।