ডিমিউচুয়ালাইজেশনের 'স্বপ্নভঙ্গ'

ম বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই ম বিনিয়োগকারীদের যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল তা কোনো কাজে আসছে না ম নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কেউ সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছে না ম ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়েছে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য, বিএসইসির খবরদারি বাড়ানোর জন্য নয় ম ছয় বছরেও ভালো মৌল ভিত্তির কোনো কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি ম বাজারে চালু হয়নি নতুন কোনো পণ্য

প্রকাশ | ২৫ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বিএসইসি ভবন -ফাইল ছবি
আহমেদ তোফায়েল পুঁজিবাজার যে কারণে ডিমিউচুয়ালাইজেশন (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথকীকরণ) করা হয়েছে তার কোনো প্রভাব বাজারে নেই। টানা মন্দার কবলে বাজার। বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীর আস্থা প্রায় শূন্যের কোঠায়। তার পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো বিকার নেই, নেই কোনো সুপরিকল্পিত উদ্যোগ। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের অভিযোগের তীর ডিমিউচুয়ালাইজেশনের দিকে। তারা বলছেন, ডিমিউচুয়ালাইজেশনের আগে যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল তা কোনো কাজে আসছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যখন বাজারে কোনো একটি কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ে, তখন ধরে নেয়া হয় ওই কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা ভালো ও ব্যবসা পরিচালনায় ভালো করছে। কিন্তু দেশের পুঁজিবাজারে উল্টো চিত্র দেখা যায়। যেমন কারসাজি করে কৃত্রিম বিক্রির চাপ তৈরি করে বা কেনার চাহিদা তৈরি করে শেয়ারের দর ওঠানামা করানো হয়। এটি দেখভাল করার জন্য কেউ সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত চার বছর ধরে দেশের অর্থনীতিতে জিডিপি সাত দশমিকের ওপরে এবং এর মধ্যে সাত দশমিক ৯ শতাংশও হয়েছে। চলতি বছরে বাজেটে জিডিপি ধরা হয়েছে আট দশমিক দুই শতাংশ। গত বছরের চেয়ে রপ্তানি আয় অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের সঙ্গে কোনোমতে এগোচ্ছে না। বরং পুঁজিবাজার অর্থনীতির উন্নয়নের বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। বাজারের এ দৈন্যদশা অর্থাৎ অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজারকে এগিয়ে নিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ বাজারসংশ্লিষ্টরা। আইসিএবির কাউন্সিল মেম্বার মাহমুদ হোসেন সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেছেন পুঁজিবাজার যে কারণে ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়েছে তার ইতিবাচক প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে না। কেউ সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। বাজারে দেশীয় ও বহুজাতিক ভালো কোম্পানিগুলো আনা যাচ্ছে না। সরকারি কোম্পানিগুলো বাজারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও সেটি বিভিন্ন কারণে অন্তর্ভুক্ত করতে পারছে না। আবার বাজারে অন্তর্ভুক্ত প্রায় ১৫২টি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন উঠছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা এর দায় এড়াতে পারে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বহুজাতিক কোম্পানি তাদের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আইসিআই, ফিলিপস, ফাইজার কোম্পানি- এদের পণ্যের খুবই জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা ছিল, তা সত্ত্বেও এরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে। শেয়ারবাজার সক্রিয় করার জন্য নব্বই দশকের দিকে সরকারের ভালো ভূমিকা ছিল। কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিকে আংশিক বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয় এবং আইপিওতে শেয়ার ছাড়া হয়। কিন্তু গত দুই দশক সংশ্‌িষ্ট সংস্থাগুলো একেবারেই নিশ্চুপ। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানকে করপোরেট রূপ দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, বিএসইসির খবরদারি বাড়ানোর জন্য নয়। শেয়ারবাজারের অস্বাভাবিক চাঙা বা মন্দাভাবের অবসানের জন্য মূল বিষয়ের প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে মনোযোগ দিতে হবে। এদিকে ছয় বছরেও দেশের স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচুয়ালাইজেশনের কোনো সুফল দেখা যাচ্ছে না। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ডিমিউচুয়ালাইজেশন যেন 'গলার কাঁটা'। ২০১৩ সালে স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচুয়ালাইজেশন হওয়ার পরে ভালো মৌলভিত্তির কোনো কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি। বাজারে চালু হয়নি নতুন কোনো পণ্য। পুঁজিবাজারকে ব্র্যান্ডিংয়ে ব্যর্থ তারা। এ কারণেই ডিমিউচুয়ালাইজেশনের কোনো সুফল বাজারে লক্ষ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ভয়াবহ ধসের পরে বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে স্টক এক্সচেঞ্জে ডিমিউচুয়ালাইজেশনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপরে জাতীয় সংসদে 'এক্সচেঞ্জেস ডিমিউচুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট ২০১৩' পাস হয়। একই বছরের মে মাসে গেজেট প্রকাশের পরে শুরু হয় ডিমিউচুয়ালাইজেশন কার্যক্রম। এতে নতুন আশায় বুক বাঁধে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এর ছয় বছর পরেও তাদের আশা এখনো হতাশার মধ্যেই রয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন যথাযথভাবে হয়নি। বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জে ৪০ শতাংশ ট্রেকহোল্ডার রেখে পেস্নয়ারদের সঙ্গে মিউচুয়ালাইজড করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেকহোল্ডাররা পুঁজিবাজারের মূল সমস্যা। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতে, দেশের পুঁজিবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের করতে ডিমিউচুয়ালাইজেশনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরে বাজারে কোনো বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি। ডিমিউচুয়ালাইজেশন-পরবর্তী নতুন পণ্য পুঁজিবাজারে চালু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ডিএসই জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে অভিযোগ বিভিন্ন মহলের। পুঁজিবাজার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মো. তৌফিক হোসেন বলেন, 'ভালো কোম্পানি না আসার একটা বড় কারণ হলো আমাদের শেয়ারবাজারটা সামষ্টিক অর্থনীতির অংশ হয়ে উঠতে পারেনি। এখনো আমরা ব্যাংকনির্ভর অর্থনীতি। ভালো শেয়ার আনতেই হবে। এছাড়া ডিমিউচুয়ালাইজেশন বলেন আর কৌশলগত পার্টনারশিপ বলেন, কোনো লাভ নেই। ভালো কোম্পানি না আসার আরেকটা কারণ হলো, আমরা তাদের আকৃষ্ট করতে পারছি না। জানা গেছে, ২০১৩ সালের স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পর আইনে ২০১৬ সালের মধ্যে কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে স্টক এক্সচেঞ্জের সংরক্ষিত ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বাধ্যবাধকতা ছিল। এখনো কোনো স্টক এক্সচেঞ্জ কৌশলগত বিনিয়োগকারী চূড়ান্ত করতে পারেনি। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়েছে। ডিমিউচুয়ালাইজেশন স্কিমের শর্ত অনুযায়ী, বস্নকড হিসেবে থাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ৬০ শতাংশ শেয়ার কৌশলগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের মোট শেয়ারের ২৫ শতাংশ (সংরক্ষিত শেয়ার থেকে) কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে এবং বাকি ৩৫ শতাংশ শেয়ার আইপিও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রি করতে হবে। অন্যদিকে ৪০ শতাংশ শেয়ারের মালিক স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য বা ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান।