বন্ড মার্কেটের প্রধান অন্তরায় উচ্চ শুল্কহার

এনডোর্সমেন্টের মাধ্যমে হস্তান্তরযোগ্য করপোরেট বন্ডের ইসু্যর ক্ষেত্রে প্রতিদান মূল্যের ওপর ২ শতাংশ স্ট্যাম্প শুল্ক রয়েছে। ডেলিভারির মাধ্যমে হস্তান্তরযোগ্য করপোরেট বন্ডের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ শুল্কহার বহাল রয়েছে। এই শুল্কহার বন্ড মার্কেট সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।

প্রকাশ | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করতে হলে প্রয়োজন শক্তিশালী বন্ড মার্কেট। আর এই মার্কেটে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য সহায়ক পরিবেশও নিশ্চিত করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিএসইসি এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। পুঁজিবাজারের উন্নয়নে অনেক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সে আইনের প্রতিফলন নেই বাজারে। এখন প্রয়োজন বাজারে বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন। তবে বন্ড মার্কেটের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে উচ্চ শুল্কহার। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, এখন সময় আসছে বন্ড মার্কেটে গুরুত্ব দেয়ার। দেশের ৯৯ শতাংশ সরকারি বন্ড। প্রাইভেট বন্ড বাড়াতে সরকারের দিক থেকে উৎসাহ দিতে হবে। কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানির সমস্যা হলো, তারা মালিকানায় প্রসার ঘটাতে চায় না। তারা ভাবে শেয়ারবাজারে গেলে শেয়ারহোল্ডাররা মালিক হয়ে যাবে। পরিবারের সদস্য নিয়ে একটি কোম্পানি করে বসে থাকলে তো তাদের সুবিধা। বন্ড মার্কেটের লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে কেউ বন্ড কিনবে না। বাংলাদেশে সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট এখনো উন্নয়ন হয়নি। আগামী দিনে এদিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্ড মার্কেটের সঙ্গে এনবিআরের সম্পর্ক রয়েছে। করহার কমালে পুঁজিবাজারে বন্ড মার্কেটটি শক্তিশালী হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে এনবিআরের এক ধরনের উদাসীনতা দেখা যায়। আর এসব নানা কারণেই বাজার দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। গত ৯ থেকে ১০ বছরে পুঁজিবাজারে নীতিগত অনেক বিষয় সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন সেভাবে কিছু হয়নি। যারা বিভিন্ন সময়ে শেয়ার কেনাবেচায় কারসাজি করেছে তাদের কোনো শাস্তি দিতে দেখা যায়নি। গত এক থেকে দুই বছরে যেসব কোম্পানি বাজারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সত্যিকার অর্থে সেগুলো বাজারে আসার মতো নয়। আবার বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য তেমন কোনো কোম্পানি আসেনি। মার্চেন্ট ব্যাংকসহ ডিএসই, সিএসইসি এবং বিএসইসি এ দায় এড়াতে পারে না। বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২০ দিনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় এক হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন এবং ৮০০ কোটি টাকা শেয়ার কিনেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এটির কারণেও বাজার চাপে রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করহার কমালে বাজারে বন্ড মার্কেটটি শক্তিশালী হতো। তবে বেসরকারি খাতের অর্থায়ন চাহিদা মেটানোর জন্য শক্তিশালী বন্ড মার্কেট গড়তে করপোরেট বন্ডে কর ছাড়ের প্রস্তাব করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। করপোরেট বন্ডের ওপর বিদ্যমান স্ট্যাম্প শুল্ক, লেনদেনভিত্তিক উৎসে আয়কর ও বিনিয়োগ থেকে আয়ের ওপর করহার কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নামাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন বিএসইসি চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন। করপোরেট বন্ডে স্ট্যাম্প শুল্ক যৌক্তিকীকরণের প্রস্তাব করে চিঠিতে খায়রুল হোসেন লিখেছেন, এনডোর্সমেন্টের মাধ্যমে হস্তান্তরযোগ্য করপোরেট বন্ডের ইসু্যর ক্ষেত্রে প্রতিদান মূল্যের ওপর ২ শতাংশ স্ট্যাম্প শুল্ক রয়েছে। ডেলিভারির মাধ্যমে হস্তান্তরযোগ্য করপোরেট বন্ডের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ শুল্কহার বহাল রয়েছে। এই শুল্কহার বন্ড মার্কেট সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। বন্ড মার্কেটের উন্নয়নের জন্য বন্ড ইসু্যর ওপর প্রযোজ্য স্ট্যাম্প শুল্ক কাগুজে বন্ডের ইসু্যর ক্ষেত্রে শুল্ক দশমিক শূন্য এক (০.০১) শতাংশ হারে বা থোক পরিমাণ হিসেবে ৫ লাভ টাকা করা যেতে পারে। তবে ডিমেটারালাইজড করপোরেট বন্ডের ওপর থেকে স্ট্যাম্প শুল্ক প্রত্যাহার করা যেতে পারে। করপোরেট বন্ডের লেনদেনভিত্তিক উৎসে আয়কর যৌক্তিকীকরণের প্রস্তাব দিয়ে খায়রুল হোসেন বলেছেন, তালিকাভুক্ত করপোরেট বন্ডের লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্রোকারদের ওপর প্রযোজ্য উৎসেকর লেনদেনের মূল্যভিত্তিক হারে বলা হয়েছে, যা লেনদেনের দশমিক এক (০.১) শতাংশ। এই উৎসেকর লেনদেনের মূল্যভিত্তিক আরোপ করার বদলে ট্রেডপ্রতি ধার্য করার প্রস্তাব করে তিনি লিখেছেন, ব্রোকাররা ট্রেড প্রতি কমিশন আদায় করে থাকেন। বর্তমানে ব্রোকাররা মক্কেলদের কাছ থেকে করপোরেট বন্ডের ট্রেডপ্রতি ১০০ টাকা আদায় করেন। এই ১০০ টাকা থেকে স্টক এক্সচেঞ্জকে ট্রেডপ্রতি ৫০ টাকা, ডিপোজিটরিকে (সিডিবিএল) ট্রেডপ্রতি ২৫ টাকা পরিশোধ করে। বাকি ২৫ টাকা থাকে ব্রোকারদের। তাই করপোরেট বন্ডের ট্রেডপ্রতি উৎসে আয়কর সর্বোচ্চ ৯.৩৭৫ টাকা বা ২৫ টাকার ৩৭.৫ শতাংশের নিচে যেকোনো পরিমাণ আরোপ করা যেতে পারে। করপোরেট বন্ডের বিনিয়োগ থেকে আয়ের ওপর কর-সুবিধা কাঠামো নিরপেক্ষ করার প্রস্তাব দিয়ে খায়রুল হোসেন লিখেছেন, বর্তমানে বন্ডের ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি শর্তযুক্তভাবে শুধুই জিরো কুপন বন্ডের ওপর প্রযোজ্য রয়েছে। এ সুবিধা সব ধরনের করপোরেট বন্ডের ক্ষেত্রে সব বিনিয়োগকারীর জন্য চেয়েছেন তিনি। বিভিন্ন দেশের উদ্যোক্তারা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের জন্য বন্ড মার্কেট থেকে অর্থায়ন পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদে আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদে অর্থায়ন করছে। এতে আর্থিক খাতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে উলেস্নখ করে সরকারের নীতিনির্ধারক ও বিশ্লেষকরা দীর্ঘদিন ধরেই বন্ড মার্কেট শক্তিশালী করার ওপর জোর দিচ্ছেন। তবে এজন্য কার্যকর তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আর্থিক খাতে বিশেষ কোনো ইনস্ট্রম্নমেন্টের ব্যবহার ছিল না। তাই ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদে আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দিতে বাধ্য হতো। এতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। এটা কখনো কখনো সংকট সৃষ্টি করে থাকে। এই জাতীয় ভারসাম্যহীন অবস্থা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। একটি গতিশীল বন্ড মার্কেটসহ অন্যান্য ইনস্ট্রম্নমেন্ট যেমন: ওয়েস আর্নার্স বন্ড, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, ট্রেজারি বন্ড ব্যবহার উৎসাহিত করব। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, পুঁজিবাজার উন্নয়নের জন্য বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন করতে হবে, করপোরেট বন্ডের কথা ভাবতে হবে।