প্রক্রিয়াজাত খাবার রপ্তানি আয়ে হোঁচট

প্রকাশ | ১০ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ইমদাদ হোসাইন
পোশাক, চামড়া, পাট কিংবা পস্নাস্টিকে রপ্তানি আলোচিত খাত। কিন্তু কিছু খাত রপ্তানি আয়ে অপ্রচলিত। যেমন রুটি, বিস্কুট, ফলের রস কিংবা চানাচুরে রয়েছে আয়ের বিশাল সম্ভাবনা। এমন সব প্রক্রিয়াজাত খাবারের রপ্তানিতে আশার আলো দেখছে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার কারণে হোঁচট খাচ্ছে তারাও। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রক্রিয়াজাত খাবার রপ্তানিতে আয় হয়েছিল ২২ কোটি ৭০ লাখ ৯০ হাজার ডলার। চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০) এখাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ কোটি ডলার। এ সময়ে খাতটিতে আয় হয়েছে ৫ কোটি ৯২ লাখ ২০ হাজার ডলার। গত বছর একই সময়ে এ খাতের রপ্তানি আয় ছিল ৭ কোটি ১১ লাখ ৯০ হাজার ডলার। সে হিসেবে গত বছরের তুলনায় আয় কমেছে ১৬ দশমিক ৮১ শতাংশ। রপ্তানিকারকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য তো আছেই বরং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও এখন বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাবার নিচ্ছেন। বিশেষ করে ভারত, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে এসব পণ্যের বাজার বাড়ছে। এছাড়া আফ্রিকার কয়েকটি দেশের মতো ইউরোপের বাজারেও রপ্তানি বাড়ছে। রপ্তানি আয়ের বড় খাত হয়ে উঠছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য। ইপিবির তথ্য হালনাগাদে দেখা যায়, গত বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে বেশি রপ্তানি হয় রুটি, বিস্কুট ও চানাচুরজাতীয় শুকনা খাবার, ভোজ্যতেল ও সমজাতীয় পণ্য, ফলের রস, বিভিন্ন ধরনের মসলা, পানীয় এবং জ্যাম-জেলির মতো বিভিন্ন সুগার কনফেকশনারি। যেমন বিস্কুট, রুটিজাতীয় শুকনা খাবার রপ্তানি করে সর্বশেষ অর্থবছরে দেশীয় কোম্পানিগুলো ২২ কোটি ৭০ লাখ ডলার আয় করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি। চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। অর্জিত আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমকি ৮২ শতাংশ কম। ইপিবির সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির অর্ডার কমেছে। সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের মূল্যও কমেছে। এছাড়া অবকাঠমোগত সমস্যা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন না করা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারসহ বিভিন্ন কারণে রপ্তানি বাণিজ্য কমে গেছে। রপ্তানি বাণিজ্য বাড়াতে হলে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে তালমিলিয়ে সরকারের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তা না হলে আগামীতে রপ্তানি আয় আরও কমে যাবে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সব ধরনের পণ্য রপ্তানিতে বৈদেশিক মুদ্রার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় এক হাজার ৪৩২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। কিন্তু এ সময়ে এ খাতে আয় হয়েছে এক হাজার ২৭২ কোটি ১২ লাখ ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ দশমিক ২১ শতাংশ কম। একই সঙ্গে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অর্জিত এ হার ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৮৪ শতাংশ এসেছে পোশাক খাত থেকে। এর বাইরে চামড়া ও চামড়াজাত এবং পাট ও পাটজাত পণ্যের পর বড় খাত হয়ে উঠছে কৃষিপণ্য রপ্তানি। কৃষিপণ্যের মধ্যে আবার দ্রম্নত বড় হচ্ছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য। বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) জানায়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানির সঙ্গে ১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান যুক্ত। এসব পণ্য বেশি যায় মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইতালিতে। বেশি রপ্তানি হওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে মসলা, চানাচুর, আচার ইত্যাদি। দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব পণ্য রপ্তানির বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের ১৪০ টি দেশে এখন কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। অবশ্য বিগত অর্থবছরে ফলের রস ও মসলা রপ্তানি কমেছে। পাশাপাশি পানীয় রপ্তানিও বাড়েনি। কিন্তু লাফিয়ে বেড়েছে ভোজ্যতেলজাতীয় পণ্য রপ্তানি। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, আলোচ্য অর্থবছরে প্রায় ৯ কোটি ডলারের সয়াবিন ও পাম তেল রপ্তানি হয়েছে। যার পুরোটাই গেছে ভারতে। নারকেল তেল রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৭ কোটি ডলারের, যা গেছে নেপালে। সরিষার তেল রপ্তানি হয়েছে ৮০ লাখ ডলারের। বাংলাদেশি সরিষার তেলের গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। রপ্তানিকারকেরা জানিয়েছেন, ফলের রস, মসলা ও কোমল পানীয় রপ্তানিতে ভাটা পড়ার কারণ নেপাল ও ভুটানে শুল্ক বৃদ্ধি। পাশাপাশি ভারতে একটি কোম্পানির নিজস্ব কারণে রপ্তানি কমেছিল, যা এখন ঠিক হয়ে গেছে। ইউরোপের মধ্যে বাংলাদেশি পণ্য বেশি যাচ্ছে যুক্তরাজ্যে। আলোচ্য অর্থবছরে যুক্তরাজ্যে ১ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের শুকনা খাবার রপ্তানি হয়। সুগার কনফেকশনারি রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ডলারের। ইতালিতেও প্রায় ১৬ লাখ ডলারের শুকনা খাবার গেছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে আরো উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ২০০১ সালে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে ঋণ গ্রহিতাকে ১০ শতাংশ সুদহারে পুনঃঅর্থয়ন সুবিধা প্রদান শুরু করা হয়। পরবর্তীতে এ তহবিলের আকার বৃদ্ধি করে ২০১২ সালে ২ বিলিয়ন টাকায় ২০১৩ সালে ৪ বিলিয়ন টাকায় এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত করা হয়। ফেব্রম্নয়ারি, ২০১৮ পর্যন্ত এ তহবিল থেকে মোট ২৭০৫টি কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে সর্বমোট ১২ দশমিক ৫১ বিলিয়ন টাকা পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা দেওয়া হয়েছে, বর্তমানে মোট ৪০টি কৃষিভিত্তিক শিল্পখাতে এ তহবিলের আওতায় পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। অবকাঠামোর দুর্বলতা ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য।