সাত বছরেও পাস হয়নি 'বাইব্যাক আইন'

৪ আইনটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির শেয়ার ফেসভ্যালুর নিচে অবস্থান করছে ৪ ২০১২ সালে বাইব্যাক আইনের খসড়া করা হলেও এখনো তা অনুমোদনের উদ্যোগ নেই ৪ পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনটি বাস্তবায়ন দরকার

প্রকাশ | ১৭ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
রাজধানীর নিকুঞ্জে ডিএসইর ভবন -ফাইল ছবি
সাত বছর ধরে লাল ফিতায় বন্দি আছে 'বাইব্যাক আইন' বা শেয়ার পুনঃক্রয় সংক্রান্ত আইন। আইনটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির শেয়ার ফেসভ্যালুর নিচে অবস্থান করছে। এতে লোকসানে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বাইব্যাক আইন থাকলে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। ২০১২ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর বাইব্যাক আইনের খসড়া করা হলেও এখনো তা চূড়ান্ত অনুমোদনের উদ্যোগ নেই। ফলে আলোর মুখ দেখছে না আইনটি। বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাইব্যাক আইন বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। বাইব্যাক হচ্ছে অধিমূল্যসহ (প্রিমিয়াম) কোনো কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর শেয়ার দর প্রাথমিক মূল্যের চেয়ে কমে গেলে ওই কোম্পানি কর্তৃক বাজার থেকে শেয়ার পুনঃক্রয়ের বিধান। এটা চালু হলে বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পাবেন। পৃথিবীর অনেক দেশে এ পদ্ধতি প্রচলিত থাকলেও দেশে বিদ্যমান কোম্পানি আইনে তা ছিল অনুপস্থিত। বরং কোনো এক অজানা কারণে আটকে আছে এ আইন চালুর প্রক্রিয়া। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, পুঁজিবাজার কারসাজিতে জড়িত হোতাদের স্বার্থ রক্ষা এবং আইনের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতেই এ আইনটি পাস করতে গড়িমসি করা হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব ব্যবসায়ীর কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অধিকহারে প্রিমিয়াম নিয়ে বাজারে এসেছে, তারা রাজনৈতিক বা আর্থিক প্রভাব খাটিয়ে এ আইন চালু বা বাস্তবায়নের রাস্তা বন্ধ করে রেখেছেন। তবে এ মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাইব্যাক আইন বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। কারণ বাইব্যাক আইনের আওতায় এলে কোম্পানিগুলোর বাজারে আসার সময় আর দুর্নীতি করতে পারবে না। ফলে আইপিও'র শেয়ার লেনদেনের প্রথম কয়েক মাস বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ নিরাপদ থাকবে। নাম না বলার শর্তে, এক সিকিউরিটিজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে বাইব্যাক আইন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে আইনটি আজও আলোর মুখ দেখেনি। আইনটি এখন কোথায় আছে তা স্পষ্ট নয়। আইনটি চালুর বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি সরকার ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দ্রম্নত এ আইন চালুর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। বাইব্যাক হচ্ছে একটি বিধান যার আওতায় কোনো কোম্পানির শেয়ার মূল্য যদি অফার মূল্যের (প্রিমিয়ামসহ) নিচে নেমে যায় বা কমে যায়। তবে ওই কোম্পানি কর্তৃক স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শেয়ার পুনঃক্রয় করতে বাধ্য থাকবেন। বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১১ সালের শুরুর দিকে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের বিপর্যয়ের পর সরকার কোম্পানি আইন সংস্কার করে বাইব্যাক অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১২ সালে আইনটির খসড়া করা হয়। এটি কোম্পানি আইনের অংশ বলে বাইব্যাক মূলত কোম্পানি আইনে অন্তর্ভুক্ত হবে। তারা আরও বলেন, বাইব্যাক নিশ্চিত হলে প্রিমিয়াম বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি বাজারে স্বচ্ছতা আসবে। বাইব্যাক কার্যকর হলে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ, স্পন্সর এবং ইসু্য ম্যানেজার সবারই দায়বদ্ধতা বাড়বে। তারা জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। কারণ শেয়ারগুলো এসব প্রতিষ্ঠানকেই (কোম্পানি, স্পন্সর ও ইসু্য ম্যানেজার) ক্রয় করে নিতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী সেটা বাইব্যাক কিংবা প্রাইস পেগিং যেটির আওতায় পড়ুক তার দায়ভার নিতে হবে কোম্পানি, স্পন্সর অথবা ইসু্য ম্যানেজারকে। জানা গেছে, বাইব্যাক আইনের চূড়ান্ত খসড়ায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ ব্যাংক, ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি), রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ (আরজেএসসি), দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি), ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি) এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মতামত দেয়। সর্বশেষ ২০১৫ সালের জুলাইয়ের মধ্যে বাইব্যাক আইনের খসড়া অনুমোদন হওয়ার কথা থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্বল মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিকে তালিকাচু্যত করা হলে এর উদ্যোক্তারা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শেয়ার বাইব্যাক করে নেন। তাছাড়া এ ধরনের কোম্পানিকে স্টক এক্সচেঞ্জ অবসায়ন ঘোষণা করে অবশিষ্ট সম্পদ আনুপাতিক হারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। কিন্তু বর্তমান কোম্পানি আইন-১৯৯৪ অনুসারে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। কোম্পানিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ কোম্পানি আইপিওতে আসার পর তার শেয়ারদর ইসু্য মূল্যের নিচে নেমে আসছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বাইব্যাক আইন চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতেন। পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বলেন, আমার মনে হয় বাইব্যাক করানোর চেয়ে ভালো কোম্পানি বাজারে আনা বিশেষ প্রয়োজন। সরকার শেয়ার ছাড়ার কথা থাকলেও তার কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। এছাড়াও দেশে ব্যবসা করছে এমন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আনতে পারলে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তিনি। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতন ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে সংবাদ সম্মেলন করে। সংগঠনের সভাপতি মিজান উর রশিদ ওই অনুষ্ঠানে ২১ দফা দাবি তুলে ধরেন তার মধ্যে বাইব্যাক আইন পাস করা ছিল তার অন্যতম দাবি। অন্য দাবিগুলো হলো, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ইসু্য মূল্যের নিচে অবস্থান করা শেয়ারগুলো নিজ নিজ কোম্পানিকে ইসু্য মূল্যে বাইব্যাক করতে হবে, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে আগামী ৩ বছর পর্যন্ত সব ধরনের আইপিও, রাইট শেয়ার ইসু্য বন্ধ রাখতে হবে, পেস্নসমেন্ট শেয়ারের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে, বুক বিল্ডিং পদ্ধতি, ডাইরেক্ট লিস্টিং পদ্ধতি বাতিল করতে হবে, সিসি আইনের বাস্তবায়ন করতে যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ব্যক্তিগতভাবে ২%, সম্মিলিতভাবে ৩০% শেয়ার নেই, সেসব উদ্যোক্তা পরিচালক ও কোম্পানিগুলোকে শেয়ার ধারণ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।