আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন

খাদের কিনারায় ভারতের অর্থনীতি!

দেশটির জিডিপি বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ৪.৫ শতাংশে

প্রকাশ | ০১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
কোনোভাবেই বিপদ থেকে অর্থনীতিকে বাঁচাতে সক্ষম হচ্ছে না নরেন্দ্র মোদির সরকার। ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়ের সাক্ষী হতে যাচ্ছে বিজেপির 'হিন্দু রেট'। কলকাতার প্রাচীন সংবাদমাধ্যম সব বিশ্লেষণ করে মতামত দিয়েছে, 'খাদের মুখে অর্থনীতি'। ভারতের অর্থনীতির এমন করুণ বিশ্লেষণ সব মাধ্যমেই। অর্থনীতির অসুখের আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণ করে, দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার আরও কমল। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে জিডিপি বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ৪.৫ শতাংশে। গতকাল সরকারি পরিসংখ্যানই জানাল অক্টোবরে আটটি প্রধান পরিকাঠামো ক্ষেত্রের উৎপাদন সরাসরি ৫.৮ শতাংশ কমেছে। অন্য দিকে, অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই রাজকোষ ঘাটতি ৭.২ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা গোটা বছরের আনুমানিক রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণের থেকে বেশি। স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ সময় দেশের আর্থিক বৃদ্ধির গড় হার ৩.৫ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করেছিল। তাকে ব্যঙ্গ করে 'হিন্দু রেট অব গ্রোথ' তকমা দেন অর্থনীতিবিদ রাজ কৃষ্ণ। সেই তকমা জনপ্রিয় হয়েছিল। মোদি সরকার দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরেই জুলাইয়ে সংসদে আর্থিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন পাল্টা বলেছিলেন, 'কংগ্রেস আমলে অর্থনীতি কেন দ্বিগুণ হয়নি? তখন কেন হিন্দু রেট অব গ্রোথ চাপানো হয়েছিল!' এ বার মোদি জমানাতেই বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশে নেমে আসায় প্রশ্ন উঠছে, 'হিন্দু রেট'-এই কি ভারত ফিরে যাচ্ছে? জেএনইউ-এর অর্থনীতির অধ্যাপিকা জয়তী ঘোষের মন্তব্য, 'হিন্দু রেট অব গ্রোথে তো তা-ও ৩.৫ শতাংশ বৃদ্ধির হার ছিল। এখন কি বৃদ্ধি আদৌ হচ্ছে? না কি অর্থনীতির সংকোচন হচ্ছে? বেকারত্বের হার, সংসারের খরচ কমে যাওয়া, গাড়ি থেকে নিত্যপ্রয়োজীয় জিনিসপত্রের বিক্রি কমা, একের পর এক সংস্থার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার মতো অর্থনীতির অন্যান্য মাপকাঠি কিন্তু সে কথাই বলছে।' জয়তী মনে করাচ্ছেন, মোদি জমানায় জিডিপি মাপার পদ্ধতি বদলে দেওয়া হয়। সেই পদ্ধতি নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। বস্তুত, মোদি সরকারের প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনই বলেছিলেন, নতুন পদ্ধতিতে জিডিপি মাপায় তা ২ থেকে ২.৫ শতাংশ অঙ্ক বেশি হচ্ছে। তার কথা মানলে আদতে আর্থিক বৃদ্ধির হার ২ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে। কেন এই হাল? বাজারে বিক্রিবাটা কমেছে। কারখানার উৎপাদনে অধোগতি। বেসরকারি লগ্নি আসছে না। বিশ্ব বাজারে ঝিমুনির ফলে রপ্তানিতেও ভাটার টান। অর্থনীতির চারটি ইঞ্জিনই ঠিকমতো না চলায় তার ধাক্কা লেগেছে অর্থনীতিতে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ আজ অর্থনীতির অবস্থাকে 'গভীরভাবে চিন্তাজনক' বলে আখ্যা দিয়েছেন। মোদি সরকার ক্ষমতায় ফিরে ৫ লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু গত ছ'বছরে অর্থনীতির অবস্থা এতখানি খারাপ হয়নি। ২০১২-১৩-র জানুয়ারি-মার্চে বৃদ্ধির হার ৪.৩ শতাংশে নেমে এসেছিল। সেই অর্থবছরে বৃদ্ধির হার মাত্র ৪.৫ শতাংশ ছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস, এপ্রিল থেকে জুনে বৃদ্ধির হার ছিল ৫ শতাংশ। পরের তিন মাসে তা ৪.৫ শতাংশে নেমে আসায় এই অর্থ বছরে বৃদ্ধির হার ৬ শতাং?শের গন্ডি টপকাতে পারবে কি না, তা নিয়েই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বৃদ্ধির হার মাত্র ৪.৮ শতাংশ। যা গত বছরে ছিল ৭.৫ শতাংশ। ভারতের আর্থিক বিষয় সচিব অতনু চক্রবর্তীর দাবি, 'আইএমএফ-ই বলেছে, এ বছর বৃদ্ধির হার ৬.১ শতাংশে পৌঁছবে। আগামী অর্থবছরে ৭ শতাংশ হবে। শেয়ার বাজারে লগ্নির আগমনও ইতিবাচক।' তার সুরেই মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কে ভি সুব্রহ্মণ্যনের দাবি, 'অর্থনীতির ভিত মজবুতই রয়েছে। অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিক থেকেই বৃদ্ধির হার বাড়তে শুরু করবে।' অর্থনীতিতে ঝিমুনি ধরার পরে হাল শোধরাতে অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যেই একাধিক চেষ্টা করেছেন। করপোরেট করের হার ৩০ থেকে কমিয়ে ২২ শতাংশ করা হয়েছে। নতুন কারখানার ক্ষেত্রে করের হার ১৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে। সুব্রহ্মণ্যন বলেন, লগ্নির গতি বাড়াতে এই করপোরেট কর ছাঁটাই দরকার ছিল। কিন্তু অর্থনীতিবিদ অরুণ কুমারের প্রশ্ন, 'করপোরেট সংস্থাগুলো যদি নিজেদের কারখানার পণ্য বাজারে বেচতেই না পারে, মানুষের আয় কমে যাওয়ার ফলে যদি বাজারে বিক্রিবাটা না হয়, তাহলে শিল্পমহল নতুন লগ্নি করবে কেন?' সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, জুলাই-সেপ্টেম্বরে বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশে নেমে আসার মূল কারণ কারখানার উৎপাদন ০.৪ শতাংশ কমে যাওয়া। কারখানার পাশাপাশি গৃহস্থ বাড়ি এবং কৃষিতে বিদু্যতের চাহিদা কমেছে। ফলে বিদু্যৎ উৎপাদনও কমেছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভারী বৃষ্টি ও দেরিতে বর্ষা শেষ হওয়ায় খনি এবং নির্মাণেও উৎপাদন কমেছে। আটটি প্রধান পরিকাঠামো ক্ষেত্রে উৎপাদন সেপ্টেম্বরেই ৫.২ শতাংশ সরাসরি কমেছিল। অক্টোবরে তা আরও বেশি মাত্রায় কমেছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, আজকের পরে অর্থ মন্ত্রক ফের রিজার্ভ ব্যাংকের ওপরে সুদ কমানোর জন্য চাপ তৈরি করবে। গতকাল রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস সংসদে এসে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বাজারের প্রত্যাশা, ডিসেম্বরে রিজার্ভ ব্যাংক ২৫ বেসিস পয়েন্ট সুদ কমাতে পারে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে? কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালার কটাক্ষ, 'মোদি সরকারের কাছে জিডিপি-র অর্থ এখন গডসে ডিভাইড পলিটিক্স।' সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, 'সব পদে ইয়েস ম্যান বসিয়ে, চাষিদের সংকট থেকে চোখ-কান বুজে থাকার ফল। এটা মোদির তৈরি বিপর্যয়।' বৃদ্ধির এই হারের পরে ২০২৪-২৫-এ ৫ লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ন পূরণ হবে কি? প্রাক্তন অর্থসচিব সুভাষচন্দ্র গর্গের মন্তব্য, 'সংখ্যার হিসেবে জুলাই-সেপ্টেম্বরে বৃদ্ধির হার ৬.১ শতাংশে নেমে এসেছে। নতুন লগ্নিতে বৃদ্ধির হার মাত্র ০.৯ শতাংশ। গোটা বছরে সংখ্যার হিসেবে বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ ছাড়াবে না। ফলে ৫ লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতির লক্ষ্যপূরণও অন্তত এক বছর পিছিয়ে যাবে।' শিল্প মহলের অনেকে বলছেন, কেন্দ্র যতই পরিস্থিতি আয়ত্তে থাকার দাবি করুক কার্যত খাদের মুখে অর্থনীতি। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধি আরও ধাক্কা খেতে চলেছে আন্দাজ করে শুক্রবারের শেয়ার বাজার নেমেছিল আগেই। সেনসেক্স ৩৩৬.৩৬ পড়ে দাঁড়ায় ৪০,৭৯৩.৮১ অঙ্কে। পরে পরিসংখ্যান বেরোতে দেখা গেল, তা হয়েছে ৪.৫%।