ভরা মৌসুমেও পর্যটকের খরা
প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:২৯
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের পর্যটন খাতের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। হরতাল ও অবরোধের কারণে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে। পার্বত্য জেলার বিভিন্ন স্থানে পর্যটক কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। এতে পর্যটন ব্যবসা-বাণিজ্যে এক রকম মন্দা দেখা দিয়েছে। সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত পর্যটনের মৌসুম ধরা হয়। বছরের এ সময় পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় ভিড় থাকলেও ফাঁকা থাকছে।
এবার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির কারণে কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে। অবরোধের কারণে চলতি মাসের শুরু থেকে সব বুকিং বাতিল করেছেন পর্যটকরা। বছরের এ সময় পর্যটন নগরীর হোটেল-রিসোর্টে ব্যাপক পর্যটক থাকলেও গত তিন সপ্তাহ প্রায় ফাঁকাই থাকছে জেলার পাঁচ শতাধিক হোটেল মোটেল ও গেস্টহাউস। এ অবস্থায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে বলে জানান সংশিষ্ট ব্যবসায়ীরা। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসার পথে গণপরিবহণ না পাওয়া ও রাস্তাঘাটে সংঘাত, সংঘর্ষের কথা চিন্তা করে বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না ভ্রমণপিপাসুরা। ফলে মৌসুমের শুরুতেই প্রায় পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। কক্সবাজারের সিগাল হোটেলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক কাজী নাসিরউদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, ভরা মৌসুমে ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। হরতাল-অবলোধের কারণে দেশি বা বিদেশি কোনো পর্যটক আসছে না। সুগন্ধার ঝিনুক ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, শীত মৌসুমের জন্য ব্যবসায়ীরা সারা বছর অপেক্ষা করে। রাজনীতি পরিস্থিতির কারণে পর্যটকের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় এ সময় পর্যটকে সরগরম থাকে। এবার মৌসুমের শুরুতেই হরতাল-অবরোধ শুরু হয়েছে। এ কারণে পর্যটক আসতে পারছে না। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যেসক পর্যটকরা হোটেল বুকিং করেছিলেন, তারা টানা অবরোধের কারণে বুকিং বাতিল করেছেন। রাজনীতির অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে লোকসানের মুখে পড়েছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটার পর্যটন খাত। হোটেল সি-ক্রাউনের পরিচালক সৈয়দ মো. ফিরোজ জানান, পর্যটক না এলেও তাদের কর্মচারী, বিদ্যুৎ বিল ও অন্য খরচ করতে হচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ব্যবসা ভালোই যাচ্ছে। তবে হরতাল অবরোধে সব বুকিং বাতিল হয়েছে।
অবরোধে সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে। সুন্দরবন ভ্রমণে যুক্ত অনেক লঞ্চ এখন আর চলাচল করছে না। সুন্দরবনে পর্যটনের মূল মৌসুম শুরু হয় অক্টোবরে, চলে মার্চ পর্যন্ত। এই ছয় মাসের পর্যটন ব্যবসার জন্য ট্যুর অপারেটররা বসে থাকেন বাকি ছয় মাস। পর্যটন মৌসুম হিসেবে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন দেশি-বিদেশি পর্যটক। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেখা মিলছে না ভ্রমণপিপাসুদের। সুন্দরবনে এক দিনে ভ্রমণের জনপ্রিয় স্থান করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র। প্রতিবছর সেখানে এক লাখের বেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। তবে এবার সেখানে পর্যটকদের খরা চলছে। ওই কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির জানান, অবরোধের কারণে ভ্রমণপ্রিয়াসীরা পরিবার নিয়ে আসতে পারছেন না।
এ বিষয়ে প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক রহমান বলেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশি ও বিদেশি পর্যটকরা শুধু নভেম্বর নয়. ডিসেম্বর ও জানুয়ারির জন্য করা বুকিং বাতিল করছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি হরতাল অবরোধ পর্যটনের জন্য বড় বাধা। মঙ্গলবার বিদেশি ৯ জনের একটি পর্যটন টিম বাংলাদেশে আসার কথা। এর মধ্যে ৭ জন ব্রিটিশ, ১ জন জার্মানি ও একজন ইন্ডিয়ান। তাদের পুরান ঢাকা ও সুন্দরবন যাওয়ার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তাদের নিয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে। দেশের পর্যটকরাও ভয়ে তাদের বুকিং বাতিল করছে।
খুলনায় পর্যটন ব্যবসায় এক রকম ধস নেমেছে। একের পর এক বাতিল হচ্ছে পর্যটকদের ভ্রমণের বুকিং। অন্যদিকে নতুন করে পর্যটক না পাওয়ায় ভরা মৌসুমেই অনেকটা অলস সময় কাটাচ্ছেন ট্যুর অপারেটর বা পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একের পর শিডিউল বাতিল হওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের।
সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র জাফলং, ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটক কমে গেছে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের পর্যটন কেন্দ্র ভোলাগঞ্জে পর্যটক নাই। সেখানকার সাদা পাথরের নৌকার মাঝি তাহির মিয়া জানান, অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে হাতেগোনা পর্যটক আসছেন সাদা পাথরে। বছরের এ সময় শ্রীমঙ্গলের হোটেল-রিসোর্টে প্রচুর পর্যটক থাকলেও অবরোধে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে জেলার পর্যটননির্ভর অর্থনীতির চাকা। সারাবছরই সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকরা আসেন। কিন্তু অবরোধে সিলেটের হোটেল-রিসোর্টগুলো প্রায় পর্যটকশূন্য। হরতাল-অবরোধে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওড়ের পর্যটক আসা কমে গেছে। ফলে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন পর্যটকবাহী নৌকার মালিক কর্মচারীরা।
পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িও বান্দরবানের পর্যটন স্পটগুলোতেও পর্যটক যাচ্ছে না। রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার হোটেল সাংহাই ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ রনি জানান, অবরোধের কারণে তাদের হোটেলে একজনও পর্যটক নেই। গত দুই সপ্তাহে ৮০ শতাংশ বুকিং বাতিল হয়েছে প্রতি বছর শীত মৌসুমের শুরুতে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র, তারেং, রিসাং ঝরনাসহ জেলার সব দর্শনীয় স্পটগুলোয় পর্যটকের পদচারণায় মুখর থাকে। অবরোধের ফলে খাগড়াছড়ির সব পর্যটন এখন ফাঁকা। খাগড়াছড়ি ও সাজেকে গড়ে ওঠা প্রায় ৩০ হোটেল-মোটেল, রিসোর্টে পর্যটক নেই। অবরোধ কর্মসূচিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবান জেলা পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে। পর্যটনের ভরা মৌসুমে মুখ থুবড়ে পড়েছে জেলার পর্যটননির্ভর অর্থনীতির হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির কারণে শেরপুরের পর্যটন স্পটগুলোয় চলছে খরা। অন্যান্য বছরের নভেম্বরের শুরুতই গারো পাহাড়ের অবকাশ পর্যটন কেন্দ্র ও মধূটিলা ইকোপার্ক হয়ে ওঠে সরব। এবার হরতাল-অবরোধের প্রভাবে বিনোদন কেন্দ্রগুলো এখনো ফাঁকা।
যাযাদি/ এস