কাউনিয়া কলেজের অধ্যক্ষ মুসা আহমেদ সাময়িক বরখাস্ত

প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০২০, ২১:০১

কাউনিয়া (রংপুর) প্রতিনিধি

 

 

 

রংপুরের কাউনিয়া কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ না করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিজির প্রতিনিধিরা বাড়িতে বসে তৈরি করা রেজাল্ট শিট ও নিয়োগসংক্রান্ত কাগজে স্বাক্ষর করে মুসা আহমেদকে অধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচিত করেন। এ অনিয়ম ও জালিয়াতি প্রমাণিত হওয়ায় কাউনিয়া কলেজের অধ্যক্ষ মুসা আহমেদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত বুধবার কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও ইউএনও মোছা. উলফৎ আরা বেগম।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছর কাউনিয়া কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ওই কলেজের উপাধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুসা আহমেদ নিজে সহ পাঁচজন আবেদন করেন। পরীক্ষা গ্রহণের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ও পরিচালক ডা. গোলাম সাব্বির সাত্তারকে এবং ডিজির প্রতিনিধি সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর চিন্ময় বাড়ৈকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

 

গত ৭ জুন রংপুর সরকারি রোকেয়া কলেজ ভেন্যুতে নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ওইদিন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় নাই এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি রাজশাহী থেকে রংপুরে আসেন নাই। অথচ প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই অনিয়ম ও জালয়াতি করে মুসা আহমেদ নিজেকে অধ্যক্ষ ঘোষণা করেন। তার বিরুদ্ধে নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল শিটসহ নিয়োগ সংক্রান্ত কাগজপত্র জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে।

 

এ ব্যাপারে গত ২১ সেপ্টেম্বর কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য আব্দুল মজিদ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও ইউএনওর বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেন। এরই প্রেক্ষিতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি রাকিবুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। গত ১৫ নভেম্বর কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তদন্ত কমিটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিজির প্রতিনিধি, নিয়োগ কমিটির সভাপতি, সদস্য ও প্রার্থীদের বক্তব্য এবং নিয়োগ সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে কাউনিয়া কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগে অনিয়ম ও জালিয়াতির সত্যতা পায়।

 

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ডিজির প্রতিনিধি লিখিত পত্রে জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ মতভেদের কারণে গত ৭ জুন কাউনিয়া কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে রেজাল্ট শিটসহ নিয়োগসংক্রান্ত কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার বিষয়ে কোনো বক্তব্যে কিছু উল্লেখ করেন নাই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিধি লিখিত পত্রে জানিয়েছেন, অধ্যক্ষ মুসা আহমেদ তাকে মুঠোফোনে জানান, সংশ্লিষ্ট সদস্যগণের উপস্থিতিতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। পরে মুসা আহমেদ রাজশাহীতে তার বাড়িতে এসে নিয়োগ সংক্রান্ত সকল কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে যান। এছাড়া ভুলভাল বুঝিয়ে নিয়োগ কমিটির সদস্য আনছার আলী এবং সদস্য সচিব ফজলুল হক সরকারের কাছেও স্বাক্ষর নেওয়া হয়।

 

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি ও বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি মহোদয় মুঠোফোনে জানিয়েছেন, অভিযুক্ত মুসা আহমেদ নিয়োগ কমিটির চারজন সদস্যের স্বাক্ষর করা রেজাল্ট শিট ও রেজুলেশন নিয়ে তার কাছে আসে। নিয়োগ পরীক্ষা যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছে বলে রেজাল্ট শিট, রেজুলেশন ও নিয়োগপত্রসহ নিয়োগ সংক্রান্ত সকল কাগজপত্রে তাকে স্বাক্ষর দিতে অনুরোধ করলে তিনি স্বাক্ষর করেন। এছাড়া শঠিবাড়ী কলেজের উপাধ্যক্ষ ও প্রার্থী হাশেম আলী নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন নাই। অথচ ভুয়া খাতা ও উত্তরপত্র তৈরি করে পরীক্ষার ফলাফল শিটে তাকে ৩৩ নম্বর দেওয়া হয়েছে।

 

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অধ্যক্ষ মুসা আহমেদ পরিকল্পিতভাবে নিজেকে অধ্যক্ষ নিয়োগ পাওয়ার জন্য অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ সম্পন্ন করেন। এদিকে অনিয়ম ও জালিয়াতির পরও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শকের স্বাক্ষরিত পত্রে মুসা আহমেদকে গত ৯ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষ পদে নিয়োগদানে অনুমতি এবং ৪ অক্টোবর যোগদানের অনুমোদন করা হয়।

 

উপজেলা নির্বাহী অফিসার  মোছা. উলফৎ আরা বেগম জানান, অধ্যক্ষ নিয়োগে অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মুসা আহমেদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডক্টর শ্বাশত ভট্টাচার্যকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, মুসা আহমেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

 

তবে মুঠোফোনে অধ্যক্ষ মুসা আহমেদ তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হন নাই। 

 

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকটি কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিজির প্রতিনিধিরা কোনো প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র তৈরি করে পরীক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়নসহ মৌখিক ও একাডেমিক যোগ্যতা অনুযায়ী একজনকে নির্বাচিত করেন। অথচ সরকারি এই দুই প্রতিনিধি নিয়োগ পরীক্ষা না নিয়ে অনিয়ম ও জালিয়াতিকে প্রাধান্য দিয়ে মুসা আহমেদকে রেজাল্ট শিটে প্রথম স্থান ও অধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচিত করে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। 

 

এ বিষয়ে মুঠোফোনে ডিজির প্রতিনিধি সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর চিন্ময় বাড়ৈর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি মুঠোফোন কেটে  দেন। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ও পরিচালক ডা. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, তদন্ত কমিটির কাছে দেওয়া তার লিখিত বক্তব্যই ঠিক। তবে এ বিষয়ে তিনি বিব্রত।

 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মনিরুজামান বলেন, নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ না করে নিয়োগসংক্রান্ত কাগজপত্রে স্বাক্ষর দেওয়াটা সরকারি প্রতিনিধিরাও জালিয়াতি করেছে। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাউনিয়া কলেজের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, অধ্যক্ষ মুসা আহমেদ নিজে নিয়োগে অনিয়ম ও জালিয়াতি করে ক্লিন ইমেজ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমপির সঙ্গেও প্রতারণা করেছে। অনিয়ম ও জালিয়াতির সাথে মুসা আহমেদসহ যারাই জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি জানান তারা।

 

সার্বিক বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি ও বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি মুঠোফোনে জানান, রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণে গত দুই বছর ধরে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো সভায় উপস্থিত ছিলেন না। তবে অধ্যক্ষ নিয়োগে অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়ে জানতে পেরেছেন। বর্তমান সভাপতি ও ইউএনওকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।