মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

৩৫ বছরের পঙ্গুত্ব থেকে মুক্ত পেলেন রিক্সা চালক স্বপন

চাঁদপুর প্রতিনিধি
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:৩১

দীর্ঘ ৩৫ বছরের পঙ্গু জীবন থেকে মুক্তি পেলেন হতদরিদ্র রিক্সা চালক স্বপন গাজী (৪৫)। শিশুকালের একটি দুর্ঘটনায় তার ডান পা আগুনে পুড়ে যায়। তখন সঠিক চিকিৎসার অভাবে আস্তে আস্তে পা টি পুরোপুরি বেকে গেলে পঙ্গুত্ববরণ করে নেয় স্বপন। অবশেষে দুর্ঘটনার দীর্ঘ ৩৫ বছর পরে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের অর্থপেডিক্স সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকদের কল্যাণে স্বপনের বাঁকা পা সোজা হয়েছে। এতে করে আবারো দুই পায়ে ভর দিয়ে হাটা চলা করার আনন্দে অশ্রুসিক্ত স্বপন।

স্বপনের দীর্ঘ ৩৫ বছরের পঙ্গুত্ব জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কাজ করেছেন চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের অর্থপেডিস্ক সার্জারি বিভাগের একদল চিকিৎসক। তাদেরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন হাসপাতালের এনেস্থিসিয়া বিভাগ, মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট, ওটি নার্স ও স্টাফসহ হাসপাতালের অন্যান্য বিভাগের স্টাফরাও।

চাঁদপুর সদর উপজেলার খুলিশাডুলি এলাকার মৃত ফজলুর রহমান গাজীর ছেলে রিকশা চালক স্বপন গাজী। তারা ছিলেন ৪ ভাই ৩ বোন।

স্বপন বলেন, ‘দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর আগে এক শীতের সকালে আমার বড় বোনের সাথে আগুন পোহাচ্ছিলাম। আমার বোন কোন একটি কারণে ঘরের ভেতর গেলে এসে দেখে আমার লুঙ্গিতে আগুন জ¦লছে। আমাকে উদ্ধার করতে করতে আমার ডান পায়ের হাটুর অংশের অনেকটুকু জায়গা পুড়ে যায়। পরে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার রিক্সাচালক বাবার পক্ষে ভালো কোন হাসপাতালে নিয়ে আমাকে চিকিৎসা করারো সম্ভব হয়নি। তাই সঠিক ও পরিপূর্ণ চিকিৎসার অভাবে আমার ডান পাটি বেঁকে গিয়ে পঙ্গু হয়ে যাই আমি। পরবর্তীতে আমি ক্রাচ ব্যবহার করে চলাফেরা করতাম। পড়াশুনা না করতে পাড়ায় এক পা নিয়েই রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতাম। টাকার অভাবে চিকিৎসা না করতে পেরে পঙ্গুত্ব নিয়েই মানবেতর জীবন কাটিয়েছি। আমার পায়ের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছিল, তখন আমি শরণাপন্ন হই ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে।’

চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে এসে আমার সমস্যার কথা জানাই। পরে অর্থপেডিক্স সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক দল আমার আর্থিক দুঃঅবস্থার কথা জানতে পেরে বিনা পয়সায় চিকিৎসার আশ্বাস দেন। চিকিৎসকদের পরামর্শমত আমি গত ৮ অক্টোবর চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হই। পরবর্তীতে চিকিৎসকরা আমার পায়ের অপারেশন করেন,’ হাসপাতালের বেডে শুয়ে কথাগুলো বলছিলেন স্বপন গাজী।

তিনি বলেন, দীর্ঘ পঙ্গুত্ব জীবনের অবসান হওয়ায় আমি যে কি আনন্দিত তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি এই হাসপাতালের চিকিৎসকসহ সকলের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের অর্থপেডিক্স বিভাগের চিকিৎসক আনিসুর রহমান সূফী বলেন, ‘স্বপন গাজী হাসপাতালে এসে যোগাযোগ করলে তাকে আমরা বিনামূল্যে চিকিৎসা করার সিদ্ধান্ত নেই। এ অবস্থায় হাসপাতালের অর্থপেডিক্স বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. শাহাদাত হোসেন ও সহকারী রেজিস্ট্রার ফরিদ আহমেদ চৌধুরীসহ একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তার চিকিৎসা শুরু করি।’

স্বপন গাজী যে রোগে ভূগছিলেন তা মেডিকেল পরিভাষায় পোস্ট বার্ন কন্ট্রাকচার বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ আগুনে পুড়ে শরীরের কোনো অংশ কুঁচকে যাওয়া রোগে ভূগছিলেন। আগুনে পুড়ে পা বাঁকা হয়ে তিনি ৩৫ বছর ধরে প্রতিবন্ধী জীবন পাড় করছিলেন। স¤প্রতি তার সেই কুঁচকানো অংশে ক্ষত সৃষ্টি হয়। মেডিকেল পরিভাষায় একে ‘মারজলিন আলসার’ বলা হয় যা ক্যান্সারের দিকে যাচ্ছিল।

ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘কয়েকটি ধাপে আমরা স্বপন গাজীর অপারেশনের কাজ সম্পন্ন করি। প্রথম ধাপে তার পায়ের সমস্ত পোড়া অংশ অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করি। বিষয়টি যথেষ্ট জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল। পরে বাঁকা পা সোজা করি। তার শরীরে ক্যানসারের কোন অস্তিত্ব আছে কিনা তা জানতে আক্রান্ত স্থানের মাংস পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠাই। খুশির সংবাদ হলো ঢাকা থেকে আসা রিপোর্টে দেখা যায় তার শরীরে ক্যান্সারের কোনো অস্তিত্ব নেই। রোগীকে নিয়মিত ফলোআপ করি এবং দ্বিতীয় দফা অপারেশনের উপযুক্ত হলে তার স্কিন গ্রাফট করি। বর্তমানে তিনি অনেকটাই সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন। তাকে কিছু ব্যায়াম দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিয়মিত চর্চা করলে তিনি পুরোপুরি স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারবেন বলে জানান তিনি।’

অর্থপেডিক্স বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘স্বপন গাজী এখন নিজের দু পা দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা শুরু করছেন। যা গত ৩৫ বছর যাবত তার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। তার পায়ের এই জটিল রোগ চাঁদপুরের বাইরে চিকিৎসা করতে হলে ব্যয় হতো প্রায় ৩ লাখ টাকার মতো। কিন্তু, এই হাসপাতালে আমরা তাকে এক টাকাও খরচ করতে দেইনি। স্বপন গাজীর ৩৫ বছরের এই অভিসপ্ত জীবনের অবসান হওয়ায় তার মত আমরাও অনেক আনন্দিত।

স্বপন গাজীর স্ত্রী তাসলিমা বেগম বলেন, আমাদের সংসারে এক ছেলে আর দুই মেয়ে রয়েছে। আমার স্বামী পঙ্গু অবস্থায় রিক্সা চালিয়ে অত্যন্ত কষ্ট করে সংসার চালাতো। আমি এতো টাকা ব্যয় করে স্বামীর চিকিৎসা করতে পারতাম না। হাসপাতালের চিকিৎসকরা আমার স্বামীর যে উপকার করেছেন, আজীবন আমরা এই হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।

যাযাদি/এসএইচ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে