মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ডাকাতের ভয়ে জনশূন্য একটি গ্রাম!

ইমরান হোসাইন লিখন, বগুড়া
  ১৯ জুলাই ২০২১, ২০:০৩

ডাকাতের ভয়ে জনশূন্য একটি গ্রাম। কাল্পনিক মনে হলেও এ ঘটনা ঘটেছে বগুড়ায়। প্রায় ৪০ বছর আগে সন্ধ্যা নামলেই গ্রামে ঢুকে পরত ডাকাত দল। নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, গরু-ছাগল, ধান, চাল, পাটসহ লুট করে নিয়ে যেত সর্বস্ব। এমনকি বাড়ির মেয়েদের ওপরেও নির্যাতন চালাত তারা। এই ভয় আর আতঙ্কেই একে একে ঘরবাড়ি সরিয়ে গ্রামটি এখন একেবারেই জনমানবহীন।

বগুড়া থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে সাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল ইউনিয়নের পিচুলগাড়ী গ্রাম। এই গ্রামেই ১৯৭৪ সালে মাতব্বর নান্নু মোল্লা ডাকাতদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন। ডাকাতরা নান্নু মোল্লার কাছে টাকা চেয়েছিল। টাকা দিতে অস্বীকার করলে খুন করে তাকে। পরে ভয় আর আতঙ্কে পেচুলগাড়ী গ্রামের বাসিন্দারা সেখান থেকে পার্শ্ববর্তী তারোইলসহ অন্যান্য গ্রামে চলে যান।

১৯৮২ সালের দিকে ঘটেছিল এমন ঘটনা। পেচলগাড়ি গ্রামে সে সময় ১৬টি বাড়িতে বসবাস ছিল প্রায় শতাধিক মানুষের। সেই মানুষগুলো এখনো বেঁচে আছে। তবে আর ফিরতে চান না পুরোনো স্মৃতির ওই গ্রামে। কারণ তারোইলে ও অন্য গ্রামগুলোতে এখন তাদের স্থায়ীভাবে বসবাস এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা না হওয়ার কারণে এখনো নিরাপদ নয় ওই গ্রামটি।

পুরোনো ওই পিচলগাড়ি গ্রামটির সঙ্গে জমির আইল ছাড়া কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, নেই কোনো আলোর ব্যবস্থা। রাত হলেই বেড়ে যায় নানা পশুপাখির উপদ্রব। সেখানে গিয়ে দেখা মেলে জোঁক, সাপ, শেয়ালসহ নানা ধরনের পশুপাখির। তবে মাঠে কাজ শেষে মসজিদটিতে নামাজ পড়তে যাওয়া লোকগুলোর কোনো ক্ষতি করে না জীব-জন্তুরা।

বর্তমান প্রজন্মের যুবকরাসহ অনেকেই ফিরতে চান গ্রামটিতে। যাতায়াতের রাস্তা ও বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা হলেই তারা আবার বসবাস শুরু করতে চান গ্রামটিতে। এমনটাই বলছিলেন কয়েকজন মুসল্লি ও এক যুবক।

হাদিসুর নামের যুবক বলেন, গ্রাম নামের এই জঙ্গলে আমাদের জমি থাকায় একটি মুরগির খামার দিয়েছি। সারাদিন নানা কাজকর্মে এখানেই থাকি আবার কখনো কখনো রাতেও থাকি। তবে রাতে শেয়ালসহ নানা ধরনের পশুপাখির ডাকে ভয়ও লাগে। তবুও জীবিকার তাগিদে থাকতেই হয়।

কথা হয় নান্নু মোল্লার দুই নাতির সঙ্গে। তারা বলেন, পেচুলগাড়ি গ্রামে থাকতেই বিবাহ করেন কিন্তু প্রায়ই ডাকাতদের অত্যচারে এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন তারা।

তারা আরও বলেন, একদিন দাদা হাটে গিয়ে গরু বিক্রি করে। ডাকাতরা হাট থেকেই পিছু নেয়, টাকাও চেয়েছিল রাস্তায় কিন্তু দাদা দেননি। সেই দিনগত রাতে ডাকাতরা বাড়িতে হামলা করে সবাইকে জিম্মি করে আবারও টাকা চায় তাতেও দাদা টাকা না দিলে একটি ঢেঁকির মৌনি দিয়ে দাদার মাথায় বাড়ি দেয়। এতে অল্পক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হয়। সে ঘটনায় পুলিশ এসেছিল মরদেহ থানায় নিয়ে গেছিল এবং ময়নাতদন্তও হয়েছিল। কোনো মামলা হয়নি।

ডাকাতরা কোথাকার জানতে চাইলে বলেন, ওরা সবাই আশপাশের গ্রামের চেনা মুখ। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারিনি আমরা। তারা বেঁচে আছে কি না জানতে চাইলে আর কিছু বলবে না বলে জানান তারা।

কথা হয় গ্রামটিতে একমাত্র মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, মাঠে কাজ করতে আসা মুসল্লিদের নিয়ে ওয়াক্ত নামাজ ও শুক্রবারে জুমার নামাজ হয় এখানে। আমাদের ইচ্ছা হয় আবারও এই গ্রামে ফিরে আসতে। তবে যোগাযোগের ব্যবস্থা ও বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা হলে অনেকেই হয়তো বসবাস শুরু করবে।

গ্রামটিতে নামমাত্র উঁচু উঁচু বাড়িঘরের চিহ্ন, জঙ্গল, একটি মসজিদ ও একটি মুরগির খামার রয়েছে। এছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

এ বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলুর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি যখন সাংবাদিকতা করতাম তখন ওই গ্রামে গিয়েছিলাম এবং বিষয়টি জানি। এখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা লিখিতভাবে আবেদন করলে পেচুলগাড়ি থেকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের সঙ্গে সংযোগ রাস্তাসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

স্থানীয়রা বলেন, গ্রাম আছে মানুষ নেই এমন গ্রামকে পুনরায় বসবাসের উপযোগী করা অথবা সরকারিভাবে পুরোনো এমন ঘটনাকে স্মৃতি করে রাখতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। জায়গাটিকে স্মৃতি করে রাখতে পার্ক অথবা বিনোদন কেন্দ্র করেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেখানো যাবে বলে মনে করেন তারা।

যাযাদি/এমডি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে