বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

​ শালবাহান দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের কোটি টাকার জমি প্রভাবশালীদের দখলে

তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) প্রতিনিধি
  ১৭ আগস্ট ২০২১, ১৪:২০

প্রভাব খাটিয়ে বিদ্যালয়ের জমি দখল করে তোলা হয়েছে মার্কেট ও দোকানপাট। এমনকি বিদ্যালয়ের ভবনের প্রবেশ পথে দোকান নির্মাণ করায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের পথ বন্ধ হয়েছে। দখল করা এ জমিগুলোর মূল্য কয়েক কোটি টাকা।

দখলদারদের বিরুদ্ধে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামলা করলেও থেমে থাকেনি দখল কার্য। তাতে বাধা প্রদান করলে উল্টো দখলদারদের হামলা ও হামলার হুমকিতে পড়তে হচ্ছে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি, শিক্ষকসহ স্থানীয়দের। এরকমই অভিযোগ তেঁতুলিয়ার ঐতিহ্যবাহী মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শালবাহান দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের।

বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, স্থানীয় যুবলীগ নেতাসহ প্রভাবশালীরা বিগত কয়েক বছরে দখল করে নিয়েছে বিদ্যালয়ের ২৬ শতক জমি। এসব প্রভাবশালীর তালিকায় রয়েছেন শালবাহান ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম বুলবুল, আব্দুল কাদের, তৌহিদুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তি। তারা জমিগুলো দখল করে গড়ে তুলেছেন দোকানপাটসহ নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দিনের পর দিন এভাবে একটু একটু করে বিদ্যালয়ের জমি দখল হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আদালতে একাধিক মামলা করার পরও দখলদারদের দৌরাত্ম থামেনি। বিদ্যালয়টির নতুন ভোকেশনাল শাখার একাডেমিক ভবন নির্মিত হলেও তার যাতায়াতের রাস্তা দখল করে যুবলীগ নেতা বুলবুল নির্মাণ করেছেন দোকান। প্রতিবাদ করতে গেলেই হুমকির মুখে পড়তে হয় বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শালবাহান দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির এমপিওভুক্ত হয় ১৯৮১ সালে। সীমান্ত এলাকার শতশত শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। পাঠদানসহ বিভিন্ন শিক্ষা উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের জন্য বিদ্যালয়টির বেশ সুনাম রয়েছে। তাই স্থানীয় দরিদ্র অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এই বিদ্যালয়ে পড়ানোর বিষয়ে বেশ আগ্রহী। নেয়া হয় না কোন শিক্ষার্থীর ফি। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের দেয়া হয় স্কুল ড্রেসসহ বিভিন্ন সুবিধা। বিদ্যালয়টির মোট জমি ৮ একর ২০ শতক। এর মধ্যে বিদ্যালয় ঘেঁষে রয়েছে বড় পুকুর ও মার্কেট। কিন্তু বাজার সংলগ্ন বিদ্যালয়ের জমিগুলোর মধ্যে গত এক দশকে দখল হয়েছে ২৬ শতক জমি। যার বাজার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। এ জমিগুলো ২১ প্রভাবশালীর দখলে রয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু বক্কর সিদ্দিক কাবুল বলেন, শালবাহান ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম বুলবুল, আব্দুল কাদের, আব্দুল হাকিম ও তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত বিদ্যালয়ের ২৬ শতক জমি দখল করেছে। যার মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। বিদ্যালয়ের ভোকেশনাল শাখার একাডেমিক ভবনের প্রবেশ পথ দখল করে দোকান ঘর নির্মাণ করায় ভবনটি ব্যবহার করতে পারছেনা শিক্ষার্থীরা। দিন দিন বিদ্যালয়ের জমি দখল হলেও আমরা তাদের কিছুই করতে পারছিনা। কিছু বললেই তারা লাঠি শোঠা নিয়ে তেড়ে আসে। জমি দখলের বিষয়গুলো উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করি। তাদের পরামর্শে আমি মামলাও দায়ের করেছি।

বিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রসঙ্গে প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য আমরা স্কুল মার্কেট করেছি। সেখানকার টাকা দিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করি। আমরা কোন শিক্ষার্থীর কাছে বেতন নেইনা। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের স্কুল ড্রেজ কিনে দেয়াসহ তাদের কাজেই সব টাকা ব্যয় করা হয। বিদ্যালয়টির প্রশাসনিক কার্যক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সন্তুষ্টি হওয়ার কারণে বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের কৌশলের জন্য আমাকে বিদেশ সফরে সুযোগ করে দেয়া হয়। কিন্তু এভাবে জমি দখল হওয়ায় বিদ্যালয়ের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মামুনুর রশিদ জানান, বিদ্যালয়ের কয়েক কোটি টাকার জমি দখলে রেখেছে। জমিতে ও নির্মাণ কাজে বাধা দিতে গেলে তারা আমাদেরকে ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করছে। কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় দখলকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের অবহিত করলেও কোন সমাধান হয়নি।

স্থানীয় হুমায়ুন কবির হিটলার, মফিজুল ইসলাম ও হেলালউদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন জানান, স্থানীয় কিছু দখলবাজ ভূমিদস্যু স্কুলের জমি দখল করে কেউ মার্কেট, কেউ দোকান নির্মাণ করে ব্যবসা করছে। ভোকেশনাল বিভাগের স্কুলের সামনের জমিটা স্কুলের ছিল। বিদ্যালয়ের ভোকেশনাল ভবনের প্রবেশ পথ বন্ধ হওয়ায় তা ব্যবহার করতে পারছে না। এলাকার দূর দূরান্তের দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা এই বিদ্যালয়ে পড়তে আসে।

বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য জহির উদ্দিন বলেন, জমি সংক্রান্ত বিষয়ে মামলা চলমান থাকা সত্বেও বুলবুলের নেতৃত্বে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি আমাদের ক্রয়কৃত জমি দখল করে দোকান ঘর নির্মাণ করে রেখেছে। বাধা দিলে লাঠিশোঠা নিয়ে তেড়ে আসে। এছাড়া আমাদের একাডেমিক ভবনের নির্মাণ কাজের বাধা দিচ্ছে। বিষয়টি তেঁতুলিয়া থানায় একাধিকবার জানানো হয়েছে। আমরা চাই প্রশাসন যেন দ্রুত বিদ্যালয়ের জমি দখলমুক্ত করে।

তবে বিদ্যালয়ের জমি দখলের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা-বানোয়াট বলে সাফ জানান শালবাহান ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম বুলবুল।

তিনি জানান, বিদ্যালয়ের জমি দখল করা প্রশ্নই আসে না। ২০১৩ সাল থেকে আমার পৈতৃক ৭ শতক জমিতে আমি দোকান ঘর নির্মাণ করছি। সে সময় স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মুস্তানসের রহমান ও তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মফিজউদ্দিন বিদ্যালয়ের জমি মাপ দিয়ে আমার জমি আমাকে বুঝিয়ে দেন এরপর আমি মার্কেট ও দোকান ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করি। তারা সেসব অভিযোগ করেছে তা মিথ্যে। মূলত প্রধান শিক্ষক তার অনিয়ম ঢাকতেই আমাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে।

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, শালবাহান দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের জমি দখলের ব্যাপারে সমস্যার কথা শুনেছি। জমি নিয়ে সিভিল মামলাও চলছে। আমরা উভয় পক্ষকে নিয়ে শিগগিরই বসবো। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন জমি ফিরে পায় সেজন্য আমরা শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।

যাযাদি/ এমডি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে