শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
৭০ বছর পর মা-ছেলের মহামিলন

মরেও শান্তি পাবেন কুদ্দুস মুন্সী : চলে যাবেন বারুইপাড়া

মোঃ বাহারুল ইসলাম মোল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
  ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:০৪

দীর্ঘ ৭০ বছর পর শতবর্ষী মায়ের সাথে দেখা হওয়ায় মরেও শান্তি পাবেন বলে জানিয়েছেন ৮০ বছর বয়সী আবদুল কুদ্দুস মুন্সী ওরফে ইদ্রিস মুন্সী। আজ রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার সলিমগঞ্জ ইউনিয়নের বাড্ডা গ্রামে নিজ বাড়িতে (মুন্সী বাড়ি) সাংবাদিকদের কাছে তিনি একথা বলেন।

এ সময় কুদ্দুস মুন্সী বলেন, আমার বিশ্বাস ছিল একদিন আমার মায়ের সন্ধ্যান আমি পাবো। মায়ের বুকে ফিরতে পেরে আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে করছি।

রোববার সকালে বাঞ্চারামপুর উপজেলার আশ্রাফবাদ গ্রামের ছোট বোন ঝর্ণা বেগমের বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন কুদ্দুস মুন্সী। তখন তাকে দেখার জন্য বাড়িতে মানুষের ভীড় জমে। গত শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আশ্রাফবাদ গ্রামে ছোট বোন ঝর্ণা বেগমের বাড়িতেই হারিয়ে যাওয়ার ৭০ বছর পর ১১০ বছর বয়সী মা মঙ্গলের নেছা ওরফে আমরো বেওয়ার সাথে তার দেখা হয়। মায়ের সাথে এক রাত থাকার পর রোববার সকালে তিনি ছোটবোন ঝর্ণা বেগমসহ আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে চলে আসেন নবীনগর উপজেলার বাড্ডা গ্রামের নিজ বাড়িতে। কুদ্দুস মুন্সী বাড্ডা গ্রামের মৃত কালু মুন্সীর ছেলে।

সাংবাদিকদের কুদ্দুস মুন্সী ওরফে ইদ্রিস মুন্সী জানান, তার বয়স যখন ৬-৭ বছর তখন তার বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর কিুছুদিন পর লেখাপড়া করার জন্য তার মা তাকে তাঁর ফুফা (নবীনগর উপজেলার দীর্ঘশাইল গ্রামের) তৎকালীন সময়ে পুলিশের দারোগা আবদুল আওয়ালের কাছে রাজশাহী জেলার বাগমারায় পাঠিয়ে দেন। ফুফুর বাড়িতে থাকার সময় একদিন ফুফুর বকা খেয়ে অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান কুদ্দুস মুন্সী। তখন তার বয়স ১০ বছর।

কুদ্দুস মুন্সী জানান, ফুফুর বাড়ি থেকে বের হয়ে তিনি ঘুরতে ঘুরতে চলে যান নওগার আত্রাইয়ের সিংহগ্রামে। সেখানে একটা বড় বটগাছ ছিলো। সেই গাছের নীচে এক মহিলার সাথে তার দেখা হয়। তিনি ওই মহিলাকে মা বলে ডাকেন। পরে ওই মহিলা তাকে নিয়ে যান তার বাড়িতে। ওই মহিলার বাড়িতে ছিলেন তিনি বেশ কিছুদিন। পরে সেখান থেকে চলে যান ওই এলাকারই দুই বোন সুন্দরী ও কপিজানের আশ্রয়ে। তাদের আদর যত্নেই তিনি বড়হ ন। পরে আত্রাইয়ের চৌবাড়ি গ্রামে তিনি বিয়ে করেন। সেই সংসারে তার তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। পরে তিনি বাগমারার বারুইপাড়া গ্রামে দ্বিতীয় বিয়ে করে সেখানেই থেকে যান।

আবদুল কুদ্দুস মুন্সী জানান, তিনি সোমবার চলে যাবেন বাগমারার বারুইপাড়া। সেখানে তার সংসার আছে। মাঝে মধ্যে আসবেন নবীনগরের বাড্ডা গ্রামের নিজ বাড়িতে।

কুদ্দুস মুন্সীর বাল্য বন্ধু (সম্পর্কে চাচা) হাফিজ মিয়া বলেন, ছোট বেলা কুদ্দুস তার বন্ধু ছিলেন। এক সাথে খেলাধূলা করেছেন। কুদ্দুসের সাথে তার অনেক স্মৃতি। ৭০ বছর পর কুদ্দুস ফিরে আসায় তার খুব ভালো লাগছে। তিনি বলেন, কুদ্দুসকে দেখেই তিনি চিনতে পেরেছেন। তবে তার চেহারা আগের চেয়ে বদলে গেছে।

বন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হাফিজ মিয়া বলেন, কুদ্দুসের বয়স যখন ৫/৬ বছর তখন একদিন কুদ্দুসদের জমিতে ধান কাটার সময় কুদ্দুস মুন্সী জমিতে থাকার ইঁদুরের গর্তে হাত ঢুকায়। পরবর্তীতে তিনি চিৎকার দেন। হাফিজ মিয়া এগিয়ে গিয়ে দেখতে পান ইঁদুরের কামড়ে কুদ্দুসের হাত দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। তা দেখে কুদ্দুসের বাবা কালু মন্সী কুদ্দুসকে ৩/৪টা থাপ্পর মারে। তিনি বলেন, আমরা চাই কুদ্দুস বাকি জীবনটা গ্রামেই থেকে যাক।

বাড্ডা মুন্সী বাড়ির শফিকুল ইসলাম বলেন, গত ১২ এপ্রিল আত্রাইয়ের সিংড়া বাজারের আইয়ুব আলী নামে এক দোকানী কুদ্দুস মুন্সীকে নিয়ে ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। আইয়ূব আলীর আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডশীপ না থাকায় আমি ভিডিওটি দেখতে পাইনি। আমার সাথে আত্রাই এলাকার বাসিন্দা বর্তমানে সিঙ্গাপুর প্রবাসী মাহফুজ সাহেবের ফেসবুক ফ্রেন্ডশীপ ছিলো। আমি তার পেইজে কুদ্দুস মুন্সীর বিষয়টি ৭ সেপ্টেম্বর দেখতে পাই। ৮ সেপ্টেমর আমি মাহফুজ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে আইয়ুব আলীর ফোন নাম্বার নিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করি ও এক পর্যায়ে কুদ্দুস মুন্সীর সাথে কথা বলি। পরে গত ২০ সেপ্টেম্বর গ্রাম থেকে আমরা কয়েকজন মিলে আত্রাই গিয়ে কুদ্দুস মুন্সীর সাথে যোগাযোগ করে তাকে নবীনগর উপজেলার বাড্ডা গ্রামের পৈত্রিক বাড়িতে ফিরে আসার আমন্ত্রন জানাই। আমাদের কথা মতো কুদ্দুস মুন্সী তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শুক্রবার রাতে আত্রাই থেকে রওয়ানা হন।

তিনি বলেন, কুদ্দুস মুন্সীর মা মঙ্গলের নেছা ওরফে আমরো বেওয়া যেহেতু বাঞ্চারামপুর উপজেলার আশ্রাফবাদ গ্রামে তার মেয়ে ঝর্ণা বেগমের বাড়িতে থাকে সেহেতু শনিবার সকালে সকালে কুদ্দুস মুন্সী সেখানে গিয়েই মায়ের সাথে মিলিত হন। রোববার সকালে আমরা কুদ্দুস মুন্সীকে নিজ বাড়ি নবীনগর উপজেলার বাড্ডা গ্রামের মুন্সী বাড়িতে নিয়ে আসি। তিনি বলেন, আমরা চাই ৭০ বছর পরে হারানো ছেলেকে ফিরে পাওয়ার ঘটনাটি সাংবাদিকদের মাধ্যমে গ্রীনিজ বুকে স্থান পাক।

কুদ্দুস মুন্সীর ছোট বোন ঝর্ণা বেগম বলেন, ভাইয়ের কোন স্মৃতি আমার মনে নেই। মায়ের কাছে ভাইয়ের গল্প শুনেছি। ৭০ বছর পরে ভাইকে ফিরে পেয়ে আমার আনন্দ লাগছে। আমি চাই বাকী জীবনটা ভাই বাড়িতেই থাকুক।

কুদ্দুস মুন্সীর চাচাতো নাতি ( চাচাতো ভাইয়ের নাতি) জিসান আহমেদ বলেন, আমি দাদার কাছে কুদ্দুস মুন্সীর অনেক গল্প শুনেছি। ফেসবুকের কল্যানে ৭০ বছর পর দাদাকে ফিরে পেয়ে আমার খুব ভালো লাগছে। তিনি বলেন, কুদ্দুস মুন্সীর দুই বোন ছিলো এক বোন মারা গেছেন। কুদ্দুস মুন্সীর মা তার মেয়ে ঝর্ণা বেগমের সাথে বাঞ্চারামপুর উপজেলার আশ্রফবাদ গ্রামে থাকেন। রোববার সকালে দাদা কুদ্দুস মুন্সী বাড়িতে আসার পর আমি তার সাথে কোলাকুলি করেছি। দাদাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।

কুদ্দুস মুন্সীর সাথে নবীনগরে আসা নওগাঁর আত্রাইয়ের সিংড়া বাজারের আইয়ুব আলী বলেন, আমি কুদ্দুস মুন্সী ওরফে ইদ্রিস মুন্সীকে মামা ডাকতাম। আমি জানতাম না আমাদের এলাকায় থাকা কুদ্দুস মামা হারিয়ে যাওয়া সন্তান। তিনি বলেন, আমাদের এলাকার একটি ছেলে হারিয়ে যাওয়ার পর আমি ফেসবুকে একটি পোষ্ট দেই। তা দেখে আমাদের এলাকার এক মুরুব্বী জানান, কুদ্দুস মিয়াও হারিয়ে যাওয়া সন্তান। পরে আমি কুদ্দুস মারার সাথে কথা বললে তিনি তা স্বীকার করে আবেগ প্রবন হয়ে যান। আমি তার অনুমতি নিয়ে তার একটি ভিডিও লাইফ গত ১২ এপ্রিল ফেসবুকে পোষ্ট করি। এই পোষ্ট দেখে তার আত্মীয় স্বজনরা আমার সাথে যোগাযোগ শুরু করে। ফেসবুকের কল্যানেই কুদ্দুস মামা তার আত্মীয় স্বজনকে ফিরে পান। এতে আমি খুব খুশী।

উল্লেখ্য, ফেসবুকের কল্যানে হারিয়ে যাওয়ার ৭০ বছর পর গত শনিবার সকালে ৮০ বছর বয়সী ছেলে আবদুল কুদ্দুস মুন্সী ওরফে ইদ্রিস মুন্সীর সাথে তার শতবর্ষী মা মঙ্গলের নেছা ওরফে আমরো বেওয়ার দেখা হয়। বাঞ্চারামপুরের আশ্রফবাদ গ্রামে ছোট বোন ঝর্ণা বেগমের বাড়িতে মা-ছেলের মহামিলন হয়। এই গল্প সিনেমাকেও হার মানায়। ৭০ বছর পর মা, বোন ও আত্মীয়স্বজনকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা কুদ্দুস মুন্সী।

কুদ্দুস মুন্সীর সাথে বাঞ্চারামপুর আসেন তার ছেলে সোহেল মুন্সী, সোহেলের স্ত্রী, সোহেলের ছেলে-মেয়ে এবং আত্রাইয়ের আইয়ূব আলী।

ছেলেকে পেয়ে বৃদ্ধা মা মঙ্গলের নেছা কাঁদতে থাকেন। তিনি বলতে থাকেন কুদ্দুস তুই একদিন ফিরে আসবি এটা আমি বিশ্বাস করতাম, আল্লাহর কাছে সব সময় এই দোয়াই করেছি। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে