​বগুড়ার শেরপুরে এসআর কেমিক্যাল কারখানায় বিষাক্ত গ্যাসে চার নারী শ্রমিক হতাহত

প্রকাশ | ২১ অক্টোবর ২০২১, ২১:০৪

শেরপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি

 

অভাবের সংসার। তাই বছরখানেক আগে এসআর কেমিক্যাল কারখানায় চাকরি নেন আয়েশা আক্তার। আর স্বামী সোলায়মান আলী স্থানীয় বাজারে বাসের টিকিট বিক্রি করেন। তাদের দুজনের সামান্য আয়ের টাকায় চলে পাঁচ সদস্যের সংসার। একমাত্র ছেলে জাকারিয়া পড়ালেখা করছে। বাকি দুই মেয়ে সেলিনা ও ফাতেমাকে বিয়ে দিয়েছেন। তবে বিয়ের খরচের টাকা সংগ্রহ না হওয়ায় তাদের উঠিয়ে দিতে পারেননি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। সংসারের হাল ধরে রাখা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজন আর নেই। কেমিক্যাল কারখানাটির বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ায় স্ত্রী আয়েশা আক্তারের মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি সংসারের প্রদীপও নিভে গেছে। তাই ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে পরিবারটিতে। ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না স্বামী সোলায়মান আলী। ছেলেমেয়েদের মুখে কীভাবে দু-মুঠো আহার তুলে দেবেন- এই ভাবনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।

 

বুধবার (২০ অক্টোবর) বিকেলে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামস্থ বিএনপি দলীয় সাংসদ আলহাজ¦ গোলাম মোহাম্মদ সিরাজের মালিকাধীন এসআর কেমিক্যাল কারখানায় বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ায় ওই নারী শ্রমিক আয়েশা আক্তার (৪৫) নিহত হন। তিনি উপজেলার সীমাবাড়ী ইউনিয়নের সীমাবাড়ী গ্রামের সোলায়মান আলীর স্ত্রী।

 

এ ঘটনায় আরও তিন নারী শ্রমিক গুরুতর আহত হয়েছেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে তাদেরকে বগুড়ায় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হলেন- মির্জাপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের মনোয়ারা বেগম (২৬), ঝরনা বেগম (২৮) ও আজিরন বেওয়া (৪০)। আহতদের শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটলেও তারা সবাই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন বলে তাদের স্বজনরা জানিয়েছেন।

 

পুলিশ ও নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিনের ন্যায় বুধবার বিকেলে আয়েশা আক্তারসহ কয়েকজন নারী শ্রমিক ওই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের রান্নার কাজ করছিলেন। এ সময় হঠাৎ রান্নাঘরের পাশের একটি ঘর থেকে প্রচুর বিষাক্ত ধোঁয়া বের হতে থাকে। সেইসঙ্গে রান্নাঘরের ভেতরেও ঢুকে পড়ে এসব বিষাক্ত ধোঁয়া। এতে রান্নার কাজে থাকা নারী শ্রমিকরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে কারখানার অন্যান্য শ্রমিকরা তাদের উদ্ধার করে শেরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আয়েশা আক্তারকে মৃত ঘোষণা করেন। আর বাকি আহতদের উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দেন। এরপর তাদেরকে বগুড়ায় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।

 

বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) দুপুরে নিহত ওই নারী শ্রমিকের বাড়িতে সরেজমিনে গেলে কথা হয় তার স্বামী সোলায়মান আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেছে। বিচার চেয়ে আর কি হবে। আমরা গরিব মানুষ। দুজনের সামান্য আয়ে সংসার চলত। ছেলের লেখাপড়ার খরচ দিতাম। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, কিন্তু বিয়ের খরচের টাকা সংগ্রহ না হওয়ায় জামাইয়ের বাড়িতে উঠিয়ে দিতে পারিনি। এখন আমার কী হবে-এই বলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। মাকে হারিয়ে ছেলেমেয়েরাও প্রায় বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। পরিবারের সবার আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভাঈ হয়ে উঠেছে।

 

এদিকে স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগ, পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই ভারী শিল্পকারখানাটি জনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে। কেমিক্যাল কারখানাটির ধোঁয়া দূষণমুক্ত না করেই চুল্লির মাধ্যমে বের হওয়ায় বিষাক্ত এসব ধোঁয়ায় পবিবেশে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। কারখানাটির নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধনাগারও (ইটিপি) নেই। স্থানীয় করতোয়া নদী এবং যেখানে-সেখানে এসব বর্জ্য ফেলায় প্রভাব পড়ছে প্রতিবেশ ব্যবস্থায়। এছাড়া এলাকাটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। গাছপালা, জমির ফসল ও নদীর মাছ মরে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন।

 

বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ায় নারী শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ করা হয়নি। তবে ওই নারী শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় প্রশ্ন ওঠায় নিহতের লাশ উদ্ধার করে থানায় আনা হয়েছে। সেইসঙ্গে তার মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পাওয়া গেলেই কেবল মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানা ও বলা সম্ভব হবে। সে মোতাবেক আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এছাড়া উক্ত ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যু নেওয়া হয়েছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

 

এসব বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য জানতে এসআর কেমিক্যাল কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ সিরাজ রব্বানীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে না পাওয়ায় বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে এসআর গ্রুপের চেয়ারম্যান বিএনপি দলীয় সাংসদ আলহাজ¦ গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ সাংবাদিকদের বলেন, তাদের মালিকানাধীন কারখানায় বিষাক্ত গ্যাস বা ধোঁয়ায় কোনো নারী শ্রমিক মারা যাননি। এমনকি কেউ আহতও হয়নি। অসুস্থ হয়ে এক নারী শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া সব নিয়ম মেনেই কেমিক্যাল কারখানাটির সব কার্যক্রম চলছে। তবে একটি মহল তার এই কারখানাটি নিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছেন বলেও দাবি করেন এই সাংসদ।

 

যাযাদি/ এস