মাছ ধরার ছিপে জীবন-জীবিকা
প্রকাশ | ২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪:৩২

গ্রামের নাম বাদে মাঝিরা। যে গ্রামের বাড়ি বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে মাছ ধরার ছিপ। তাদের তৈরি ছিপ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। ছিপ তৈরি করে স্বাবলম্বী ওই গ্রামের প্রায় ২শতাধিক পরিবার। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশ নিচ্ছেন এ ছিপ তৈরির কাজে। গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে বাড়ির আঙ্গিনায় আগুনে ছ্যাক দেওয়া হচ্ছে মাছ ধরার ছিপে। এর পাশাপাশি ছিপের বাঁশ চাষও শুরু হচ্ছে এ গ্রামে। ছিপের গ্রাম হিসেবেই পরিচিতি পাচ্ছে বাদে মাঝিরা।
ময়মনসিংহ থেকে ২২কিলোমিটার অদূরে মুক্তাগাছা উপজেলার মানকোন ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম বাদে মাঝিরা। এক সময় এ গ্রামের বেশিরভাগ পরিবার বাস করত দারিদ্রসীমার নিচে। প্রধান পেশাই ছিল অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা। বেশিরভাগ সময় যখন কাজ না থাকত, তখন অভাব অনটনে কাটত তাদের দিন। এখন আর এ রকম চিত্র চোখে পড়বে না এ গ্রামের। ছিপ তৈরির কুটির শিল্পের মাধ্যমে পাল্টে গেছে গ্রামের চিত্র। ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে নানান রং বেরংয়ের ছিপ। পাল্টে যাচ্ছে জীবন যাত্রার মান।
এ গ্রামের বাসিন্দা সত্তোর্ধ্ব চাঁন মিয়া সর্বপ্রথম মাছ ধরার ছিপ তৈরির কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, আজ থেকে ৫০ বছর আগে তিনি এ কাজ শুরু করেন। তখন তিনি আগুন জ্বালিয়ে বাঁশের চোঙ্গায় ফুঁ দিয়ে বাঁকা বাঁশ সোজা করে ছিপ তৈরি করেন। এখন বৈদুত্যিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ছিপে ছ্যাকা দেওয়া হচ্ছে। তার কাছ থেকে শিক্ষা নেয় ওই গ্রামের মানুষ। এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো গ্রাম জুড়ে। বাদে মাঝিরার বাড়ি বাড়ি শুরু হয়েছে ছিপ তৈরির কাজ। এ গ্রামের প্রায় ২ শতাধিক পরিবার এখন যুক্ত হয়েছেন এ কাজে। গ্রামের মানুষ কোনো না কোনভাবে যুক্ত রয়েছেন এ পেশায়।
পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশ নিচ্ছেন ছিপ তৈরির কাজে। তারাও বাড়তি আয় করছেন বাড়িতে বসেই। ছিপ সেঁটে তারা প্রতিদিন আয় করছেন ১৫০ টাকা থেকে ২শ’ টাকা। তারা বাড়ির ভেতর ছিপের চিকন বাঁশ দা দিয়ে সেঁটে দিচ্ছেন। আর পুরুষ সদস্যরা বাড়ির আঙ্গিনায় আগুন দিয়ে ছ্যাকা দেন ওইসব চিকন বাঁশ। ছিপে আঁকেন রং বেরংয়ের নকঁশা। এই রং বেরংয়ের নকঁশা দেখে মুগ্ধ হয়ে শৌখিন মৎস্য শিকারীরা প্রতিদিন কিনে নিচ্ছেন তাদের পছন্দের ছিপ।
ওই গ্রামের বাসিন্দা আমেনা আক্তার বলেন, তারা বাড়ির কাজ শেষ করে ছিপ সেঁটে দেওয়ার কাজ করেন। সারাদিনে তারা ৫০ থেকে ৭০ টি ছিপ সাঁটেন। এতে প্রতিদিন তারা দেড়শ’ থেকে ২শ’ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। এ টাকা তারা তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার পেছনে খরচ করছেন।
আগুন ছ্যাকায় একাধিক রঙে রাঙানো হয় ওই সব ছিপ। সারা বছর তৈরি করে বছরের তিন মাস তারা বিক্রি করেন ছিপ। বিশেষ করে বর্ষাকালে ছিপ বিক্রির ভরা মৌসুম। পানি বাড়লে তাদের বিক্রিও বাড়ে। তাদের তৈরির ছিপ বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। তারা এই ছিপ তৈরির বাঁশ সংগ্রহ করেন সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা থেকে। প্রতি ছোট ছিপ কিনেন ৮টাকা ধরে আর বড় ছিপ কেনেন ১৪ টাকায়। প্রতিটি ছোট ছিপ তৈরি করতে খরচ হয় ২৩ টাকা আর বড় ছিপে ৩০ টাকা। তারা তৈরির পর এ সব ছিপ ছোটটা বিক্রি করেন ২৫ টাকা দরে আর বড় ছিপ বিক্রি করেন ৪০ টাকা ধরে। তবে বন্যা ও বৃষ্টির পানি বেশি হলে প্রতি ছিপের দাম বেড়ে যায়।
ছিপ তৈরীর কারিগর আমিনুল ইসলাম বলেন, বাদে মাঝিরা গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ছিপ তৈরি সাথে যুক্ত হয়েছেন। বাড়ি বাড়ি তৈরি হচ্ছে মাছ ধরার ছিপ। তারা তাদের বাপ—দাদার কাছ থেকে ছিপ তৈরির কৌশল আয়ত্ব করেন। এক সময় অভাব অনটনে কাটত তাদের দিন। কিন্তু এখন এই ছিপ তৈরি করে দেশের ভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। সিলেটের সুনামগঞ্জসহ নেত্রকোনায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা এই ছিপ তৈরির বাঁশ সংগ্রহ করেন। পরে এই বাঁশ আগুনে সেকে এর ওপর বিভিন্ন রকমের নকশা তৈরি করে বিক্রি করে সাবলম্বি হচ্ছেন।
গ্রাম জুড়ে ছিপ তৈরি করে কুটির শিল্প গড়ে তোলায় ছিপ তৈরির কারিগরদের প্রশংসা করে মুক্তাগাছার ইউএনও আব্দুল্লাহ আল মনসুর যায়যায়দিনকে বলেন, তৈরি মাছ ধরার এই ছিপ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি হচ্ছে।
এই ছিপ বিক্রি করে তাদের অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে সারাদেশে মুক্তাগাছার বাদে মাঝিরা পরিচিতিও লাভ করছে। তাদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় আনতে তথ্য—উপাত্ত তৈরী করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তাদের জীবনমানোন্নয়ে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটিও করা হয়েছে। তাদের এ কুটির শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারিভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে আমরা আন্তরিক বলেও জানান তিনি।
যাযাদি/এসএইচ