যে কারণে তিনমাসের শিশুকে ভিক্ষুকের কোলে রেখে যান মা   

প্রকাশ | ০৩ মার্চ ২০২৩, ১০:৩৫

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি
ছবি-যাযাদি

লক্ষ্মীপুরে ভিক্ষুকের কোলে রেখে যাওয়া শিশুর মায়ের খোঁজ মিলেছে। বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) রাত ৯ টার দিকে শিশুটির মা সহ পরিবারের লোকজন সদর থানায় আসে ভিক্ষুকের কাছে রেখে যাওয়া শিশুপুত্রকে ফিরিয়ে নিতে। তবে আদালতের মাধ্যমে ওই শিশুকে ফিরিয়ে নিতে পারবে তার প্রকৃত অভিভাবকরা। শিশুটি এখন বেলাল হোসেন-নিশি আক্তার নামে এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছেই রয়েছে। তারা পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মজুপুর গ্রামের বাসিন্দা। 

শিশুটির যে মা তাকে রেখে চলে গেছেন, সে মায়ের নাম সুরমা বেগম। তার আরও তিন মেয়ে আছে। শিশুপুত্রটির বয়স তিন মাস। নাম রেখেছেন মাহিন। বড় মেয়ের নাম নেহা (৭), মেঝো মেয়ে নুহা (৫), ছোট মেয়ে মাহি (৫)। তাদের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর বাদাম ইউনিয়নের চরসীতা গ্রামে। তাদের বাবার নাম মিরন, তিনি সৌদি প্রবাসী। শিশুটির মা জেলা শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের রেহান উদ্দিন ভূঁইয়া সড়কে সন্তানদের নিয়ে ভাড়া করা বাসায় থাকতো। তিন মেয়েকে সেখানের একটি মাদরাসায় ভর্তি করিয়েছেন। সুরমার বাবার বাড়ি সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চর উভূতি গ্রামে। 
 
কেন সুরমা তার তিন মাস বয়সী ফুটফুটে শিশুপুত্রকে বৃদ্ধা ভিক্ষুকের কাছে রেখে নিরুদ্দেশ হলেন, জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজ্জামান আশরাফ ও সাংবাদিকদের কাছে এর কারণ জানিয়েছেন তিনি।

সুরমা বলেন, আমার স্বামী সৌদিতে থাকেন। চার সন্তান নিয়ে আমি জেলা শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। প্রতিমাসে ১১ হাজার টাকা কিস্তি, সন্তানদের খরচ, সংসারের খরচ লাগে। সব মিলিয়ে আমাকে হিমশিম খেতে হয়। মুদি দোকানে অনেক দেনা হয়ে আছি। তাদের বাবা কোন খরচ দেয় না। তাই তার উপর জিদ করে এ কাজটি করেছি। শিশু সন্তানকে ভিক্ষুকের কোলে দিয়ে অন্য সন্তনদেরকে নিয়ে বাপের বাড়ি ভবানীগঞ্জের মিয়ারবেড়িতে চলে যায়। ছেলেকে না নিয়ে যাওয়ায় পরিবারের লোকজন আমাকে বকাঝকা শুরু করে। পরে বুঝতে পেরেছি কাজটি আমি ঠিক করিনি। বুকের ধনকে রেখে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। ঘটনার পরদিন সকাল থেকে তাকে খুঁজতেছি। কোথাও পাইনি। পরে বিকেলের দিকে পরিচিত একজন ফেজবুকের মাধ্যমে শিশুটির বিষয়ে জানতে পারে। তার মাধ্যমে থানায় আসি। 

শিশুটির দাদা হাফিজ উল্যা জানান, ১০ থেকে ১২ বছর আগে তার ছেলের সাথে সুরমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর ৬ মাস তাদের বাড়িতে ছিল। এরপর থেকে বাপের বাড়িতেই থাকতো। তার ছেলে মিরন (৩৪) প্রায় সাড়ে ৫ বছর ধরে সৌদি আরবে থাকে। আর তার পুত্রবধু নাতি-নাতনীদের নিয়ে জেলা শহরে ভাড়া থাকে। তার ছেলে সংসারের খরচ পাঠায়। তারপরও তার পুত্রবধূ মানষিক সমস্যার কারণে তার নাতিকে ভিক্ষুকের কাছে রেখে চলে যায়। বিষয়টি তারা ঘটনার রাতে সুরমার বাবার কাছ থেকে ফোনে জানতে পারেন। এটা কোন স্বাভাবিক মানুষের কাজ না। তবে নাতিকে ফিরে পেয়ে খুশি তিনি। 

এদিকে বুধবার (১ মার্চ) বিকেলে পুলিশ শিশুটিকে ভিক্ষুকের কোল থেকে উদ্ধারের পর স্থানীয় কাউন্সিলর জসিম উদ্দিন মাহমুদের তত্বাবধানে দেওয়া হয়। কাউন্সিলর তার আত্মীয়ের ঘরে লালন-পালনের জন্য রাখেন শিশুটিকে। তারা নিঃসন্তান দম্পতি ছিল। বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) দুপুরে শিশুটিকে পুলিশ আদালতে সোপর্দ করে। তার দায়দায়িত্ব সমাজসেবা কার্যালয়কে দেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। পরে ওই নিঃসন্তান দম্পতি আদালতের কাছে শিশুটিকে লালন-পালনের আবেদন জানালে শর্ত সাপেক্ষে তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) রাতে শিশুটির মায়ের খোঁজ পাওয়ার পর ওই দম্পতি শিশুটিকে নিয়ে থানায় যান। এসময় তাদেরকে কান্না করতে দেখা গেছে। একদিনের মধ্যেই শিশুটিকে আপন করে নিয়েছেন তারা। এসময় শিশুটির প্রকৃত মা বার বার ওই দম্পতির পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় তার সন্তানকে ফিরিয়ে নেওয়ার আকুতি জানান। 

এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহফুজ্জামান আশরাফ সাংবাদিকদের বলেন, শিশুটিকে পাওয়ার পর আমরা স্থানীয় কাউন্সিলরের তত্বাবধানে দিই। পরদিন আমরা শিশুটিকে আদালতে সোপর্দ করি। আদালত থেকে ওই দম্পতিতে লালন-পালনের দায়িত্ব দিলেও শর্ত ছিল শিশুটির পরিবারকে পাওয়া গেলে তাদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। এখন তার মা এবং পরিবারের খোঁজ মিলেছে। আমরা আদালতে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেব। আইনী পক্রিয়ার ভিত্তিতে শিশুটিকে আদালতের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারবে তার মা। তবে সে সময় পর্যন্ত শিশুটি ওই নিঃসন্তান দম্পতির কাছে থাকবে। 

উল্লেখ্য, বুধবার (১ মার্চ) দুপুর ২টার দিকে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মজুপুর গ্রামের আধুনিক হাসপাতালের সামনে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারী ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে তার কোলের শিশুকে সালমা বেগম (৭০) নামে এক ভিক্ষুকের কোলে রেখে যান। কিন্তু এরপর আড়াই-তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও ওই নারী আর ফিরে আসেননি।

যাযাদি/ এস