দুর্গম অঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবা পেতে আকুটি ৩শত পরিবারের মাওশিশু
প্রকাশ | ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৫৪
বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউপি পর্যটন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। ভ্রমণকারীদের জন্য এলাকাটি অতি জনপ্রিয় হলেও ওই এলাকার ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করে আসা শিশুরা শিক্ষা,চিকিৎসাসহ নূন্যতম মৌলিক অধিকারের কথা জানেন না ।
স্থানীয়রা জানায়, থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউপির ৬ ও ৯ নম্বর দুই ওয়ার্ডে প্রায় গত ২০-৩০ বছর থেকে মেনহাত ম্রো পাড়া , বুলু পাড়া , থাংকোয়াই ম্রো পাড়া, কোয়াংক্ষ্যং পাড়া, ইয়ং ডং ম্রোক্ষ্যং পাড়া, চন্দ্র মোহন ত্রিপুরা পাড়া, ক্লুং ক্ষ্যং ম্রো পাড়া, রুইওয়াই ম্রো পাড়া , কংকং ত্রিপুরা পাড়া, ইয়ং ক্লাং ম্রো পাড়া, মালুমগ্যা পাড়া, সূর্য্যমনি ত্রিপুরা পাড়া,লাই পুং পাড়া , ইয়াংবং, মাংচাই, বাচি অং, মেথোয়াই পাড়া, মেনপ্রে ম্রো পাড়াসহ মোট ১৮ /১৯ টি পাড়া গড়ে উঠেছে।
এসব পাড়ায় ৩০০ পরিবারের প্রায় ২ হাজারেরও বেশি ম্রো,ত্রিপুরা, মারমা পরিবারের বসবাস। যার মধ্যে অন্তত একতৃতীয়াংশের বেশি শিশু -কিশোর রয়েছে। গত ২০-৩০বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস শুরু হলেও কোনদিনও কোন স্বাস্থ্য কর্মীরা পৌঁছায়নি এই পাড়া গুলোতে, তেমনি পায়নি কোন প্রকার সরকারি বরাদ্ধের অতি প্রয়োজনীয় ভিটামিন-এ ক্যাপসুল বা রোগ প্রতিরোধক টিকা। গড়ে উঠেনি কোন সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও । ফলে শিক্ষার আলোহীন,শারীরিক অপুষ্টি জনিতসহ নানা রোগ-শোকের মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠা যেন তাদের নিয়তি। বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও যেন কোন এক আদিম যুগে বসবাস তাদের।
সরেজমিনে গেলে কথা হয় লইক্রি পাড়ার পাড়া প্রধান ঙৈ তং ম্রো কারবারি জানান, প্রায় ২০ বছর আগে ২০ পরিবারের ১০০ জন সদস্য মিলে লইক্রি পাড়া এলাকায় বসতি গড়ে তুলেন। বর্তমানে ৩৭ পরিবারের প্রায় আড়াইশ জনের বসবাস। এই ২০ বছরের মধ্যে কোন স্বাস্থ্য কর্মী তাদের পাড়াটিতে আসেনি এবং গত ১৯ বছরের মধ্যে কোন স্কুলও ছিল না। কোন স্বাস্থ্য কর্মী তাদের পাড়াটিতে না যাওয়ায় আজ পর্যন্ত কোন শিশুই সরকারি ভাবে দেওয়া ভিটামিন-এ ক্যাপসুল বা রোগ প্রতিরোধক টিকা পায়নি।
তিনি আর ও জানান, চলতি বছরের জানুয়ারিতে থানচি সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম মংওয়ে মাহাজনের ছেলে মংমংসিং হাতে গড়ার স্থানীয় এনজিও সংস্থা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের বাস্তবায়নে লইক্রি পাড়া এলাকায় চতুর্থ শ্রেনী পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও বাকি ১৭ পাড়ায় কোন প্রকার শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ নেই শিশুদের।
রেমাক্রী ইউনিয়নের ৬নম্বর ওয়ার্ড ডলুঝিড়ি পাড়ার কারবারি (পাড়াপ্রধান) চন্দ্র মোহন ত্রিপুরা ও ৯নম্বর ওয়ার্ড পান ঝিড়ি (কোয়াইং ক্ষ্যং) ম্রো পাড়ার কারবারী পাড়াপ্রধান কাইং ওয়াই ম্রো জানান, ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড মিলে আঠারোটি'র বেশি পাড়ায় প্রায় ২ হাজারের অধিক জনগনের বসবাস হলেও আজ পর্যন্ত তাদের পাড়ায় কোন ডাক্তার বা স্বাস্থ্য কর্মীরা আসেনি। ফলে পাড়ার শিশুরা যেমন কোনদিন টিকা ও ভিটামিন-এ ক্যাপসুল পায়নি তেমনি গর্ভবতী মায়েরাও পায়নি স্বাস্থ্য সেবা বা ডাক্তারি পরামর্শ। এছাড়াও এই এলাকায় কোন স্কুল না থাকায় শিক্ষার আলো কি জিনিষ হানেন না শিশুরা।
রেমাক্রি ইউপির ৬নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মানচং ম্রো জানান, এলাকাটি দুর্গম আর যাতায়াত ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়ার কারনে স্বাস্থ্য কর্মীরা যেতে আগ্রহী নয়। যার কারনে ৬নম্বর ওয়ার্ড এলাকার শিশুরা কোনদিন ভিটামিন -এ ক্যাপসুল ও টিকা পায়নি। আগামীতে এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মী নিয়ে যাওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করবেন বলে জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বান্দরবান কার্যালয় হতে, জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি ও ভিটামিন-এ প্লাস ক্যাম্পেইন জেলায় শতভাগ শিশুকে টিকা বা ভিটামিন-এ প্রদানের কথা বলা হলেও রেমাক্রী ইউপি চেয়ারম্যান মুই শৈ থুই মারমা জানান, থানচি উপজেলার আয়তন ১০২০বর্গ কিলোমিটার তার মধ্য শুধু,রেমাক্রী ইউনিয়নের আয়তন ৪৯৭ বর্গকিলোমিটার যা রুমা-রোয়াংছড়ি উপজেলা থেকেও বেশি আয়তনের। ২০২২সালের জনশুমারী অনুসারে রেমাক্রী ইউনিয়নের জনসংখ্যা ৮হাজার ৬'শ দেখানো হলেও ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যমতে বর্তমানে এই ইউনিয়নে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৩হাজার। যার মধ্যে ইউনিয়নের ৬নম্বর ও ৯নম্বর ওয়ার্ডে ৩০০ পরিবারের প্রায় ২ হাজার জনগনের বসবাস হলেও এলাকাটি দূর্গম ও যোগাযোগের মাধ্যম একমাত্র নৌ-পথ হওয়ার কারনে ওই এলাকার শিশুরা কখনো ভিটামিন-এ ক্যাপসুল ও টিকা দেয়া সুযোগ হয় নি ।
জানতে চাইলে উপজেলা প্রাথমিক সহকারী শিক্ষা অফিসার( এটিও) মো: নিজাম উদ্দিন বলেন, ঐ অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আগে জানতাম না। উর্ধত্ব কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেবো।
যোগাযোগ করা হলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও প: প: কর্মকর্তা ডাঃ মো: ওয়াহিদুজ্জামান জানান, সকল জনগনের স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এই এলাকার কিছু কিছু বিষয় সম্পর্কে জানা নেই। যতটুকু শুনেছি ঐ এলাকাগুলো বেশ দূর্গম। তবুও সকলের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে রেমাক্রির ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ঐ দূর্গম এলাকা গুলোতে অন্তত প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর একটি ক্রাশ প্রোগ্রামের ( বিশেষ ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম) মধ্যে সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে জানান তিনি।
যাযাদি/ এস