কমিটি বিলুপ্তির ৫ মাস পর
দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক পদপ্রার্থীদের সাথে মতবিনিময় সভা ডেকেছে কেন্দ্রীয় কমিটি
প্রকাশ | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৩৩

এবার কমিটি বিলুপ্তির ৫ মাস পর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে আসতে চাওয়া সভাপতি-সম্পাদক পদপ্রার্থীদের সাথে মতবিনিময় সভা ডেকেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। সাংগঠনিক গতিশীলতা বাড়াতে পদ প্রার্থীদের সাথে মতবিনিময় সভা ডেকেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের দপ্তর সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম পান্থ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা গেছে।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের এক জরুরি সিদ্ধান্ত মোতাবেক জানানো যাচ্ছে যে, 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গড়ার লক্ষ্যে ছাত্রসমাজ ও তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শাখার সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীদের নিয়ে একটি 'মতবিনিময় সভা' অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিকাল ৩টায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে।
মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শাখার সকল সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীদের উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে কমিটি বিলুপ্তির খবর জানানো হয় গণমাধ্যমে।
একই সঙ্গে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের অধীনে ঘোষিত চার উপ কমিটিও বিলুপ্তির ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের অধীন বিলুপ্ত উপ কমিটিগুলো হলো, বাঁশখালী উপজেলা ছাত্রলীগ, বাঁশখালী পৌরসভা ছাত্রলীগ, আলাওল সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগ এবং সাতকানিয়া কলেজ শাখা ছাত্রলীগ।
২০১৭ সালে ১৪ অক্টোবর বোয়ালখালী উপজেলার এস এম বোরহান উদ্দিনকে সভাপতি এবং আনোয়ারা উপজেলার মো. আবু তাহেরকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পরে ২০২০ সালের ৪ মার্চ পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়।
অভিযোগ উঠেছিল, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অছাত্র, বিবাহিত, শিবির ক্যাডার, অশিক্ষিত, নাশকতা ও চুরির মামলার আসামি, কাপড়ের দোকানদার, রেলের খালাসি, ব্যাংকারসহ বিতর্কিত ও অযোগ্যরা স্থান পেয়েছিল। এ নিয়ে জেলার তৃণমুল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছিল।
এছাড়াও জেলা ছাত্রলীগের ইতিহাসে ২৭৬ সদস্যের বিশাল কমিটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল তখন।
আরো অভিযোগ উঠেছিল, কমিটিতে স্থান দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশাল বাণিজ্য হয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান অনেক নেতা এবং আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলরা এ কমিটি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
এসময় সাধারণ নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছিলেন, কমিটির সহ-সভাপতি সোহরাব হোসেন চৌধুরী শুভ একটি হত্যা মামলার আসামি। কেএম পারভেজ উদ্দীন ছিলেন শিবির ক্যাডার। মো. মিনহাজুল আবেদীন নগরীর রেয়াজউদ্দীন বাজার তামাকুমণ্ডী লেইনের দোকানদার। ফয়সাল জামিল সাকির বয়স ৩৪ বছর। মো. মঈন উদ্দিন বিবাহিত। আবদুল খালেক খালিদ চন্দনাইশের কাঞ্চন নগর গ্রামে মায়মুনা হত্যা মামলার আসামি।
জয়নুল আবেদিন ব্যাংকার। মামুন চন্দনাইশে নারী নির্যাতন মামলার আসামি। মনজুর আলম এসএসসির গণ্ডি পেরোননি, টেরিবাজারের দোকান কর্মচারী তিনি।
নেতাকর্মীরা আরো অভিযোগ করেছিলেন, সহ-সম্পাদক মো. রায়হান বাংলাদেশ রেলওয়েতে খালাসি হিসেবে কর্মরত আছেন। মোস্তাক আহমদ বিবাহিত। সাইফুদ্দিন খালেদ এসএসসি পাস করেননি। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বহুজাতিক সার কারখানা কাফোকোতে চাকরি করেন। বদরুদ্দোজা জুয়েলও জেলা ছাত্রলীগের আহবায়ক আবদুল মালেক জনি হত্যা মামলার আসামি। সাংগঠনিক সম্পাদক কলিমুল্লাহ সাতকানিয়ার চিহ্নিত শিবির ক্যাডার। তিনি সাতকানিয়ার কেরানি হাটে জ্বালাও-পোড়াও নাশকতার ঘটনায় করা মামলার আসামি। হামিদ হোসাইন কোতোয়ালি থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের ভাই। উপ-সম্পাদক মোহাম্মদ এনাম খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বনফুলে চাকরি করেন (পটিয়া)। উপ-অর্থ সম্পাদক শহীদুল আলম একজন জুতা ব্যবসায়ী। উপ-ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এসএম সাইফুল্লাহ রাহাত ফোরএইচ গ্রুপের হিসাবরক্ষক। তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সুমি আক্তার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী ছিলেন। শিক্ষা ও পাঠচক্র উপসম্পাদক হয়েছেন ফিরোজুল ইসলাম মুন্না। তিনি ঢাকায় একটি কারখানায় কর্মরত। কার্যকরী সদস্য মিজানুর রহমান লোহাগাড়া পূর্ব পুটিবিলা স্কুলের দপ্তরি। আক্কাস উদ্দিন একজন চিহ্নিত রাজাকারপুত্র! সেসময় ফেসবুকে কমিটির যুগ্ম সম্পাদক রিদুয়ানুলের একটি ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। ওই ছবিতে দেখা গেছে একটি চুরির মামলায় অন্য তিনজনসহ তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে সাতকানিয়া থানা পুলিশ। তখন সাবেক ছাত্রনেতা তছলিম উদ্দিন রানা একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, হায়রে ছাত্রলীগের কমিটি- কী করে ছাত্রনেতা হয় জানতে ইচ্ছা হয়...।
দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ছাত্রনেতারা বলেন, বোরহান-তাহের কমিটি ছিল জেলা ছাত্রলীগের ইতিহাসের সবচেয়ে সমালোচিত কমিটি। তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে খোদ আওয়ামী লীগও বিব্রত ছিল। মোটরসাইকেল চুরির মামলায় পুলিশ দড়ি বেঁধে যে ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে, যার ছবি পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে সেই ছেলেকেও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে দেখা গেছে। চিহ্নিত শিবির ক্যাডারও ছিল বিলুপ্ত কমিটির ছাত্রলীগ নেতা। কমিটিতে অযোগ্য, অছাত্র, অনুপ্রবেশকারী শিবির ক্যাডারদের স্থান দেওয়া হয়েছে যা কাম্য ছিল না। ঐতিহ্যবাহী একটি ছাত্রসংগঠনকে এভাবে কলুষিত করার কোনো মানে হয় না। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ যুগোপযোগী একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দীর্ঘ ২২ বছর পর ২০২০ সালে গঠিত কমিটির আগে কখনো আংশিক কমিটি, কখনো ছিল আহ্বায়ক কমিটি। ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর এসএম বোরহান উদ্দিনকে সভাপতি ও আবু তাহেরকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫১ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল।
২০২০ সালের ৪ মার্চ ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সভাপতি এসএম বোরহান উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। এছাড়াও ৬০ জন সহসভাপতি, ৩৫ জন সহসম্পাদক, ১১ জন যুগ্ম সম্পাদক, ১১ জন সাংগঠনিক সম্পাদক, বিভাগীয় ও উপ-সম্পাদক ১৪৮ জন ও কার্যকরী সদস্য রাখা হয়েছে ১১ জন।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৪ মার্চ বোয়ালখালীর এস এম বোরহানকে সভাপতি ও আনোয়ারার আবু তাহেরকে সাধারণ সম্পাদক এবং হোসাইন মোহাম্মদকে সাংগাঠনিক সম্পাদক করে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের ২৭৬ সদস্যের কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। কমিটি ঘোষণার তিন দিনের মাথায় জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি তাওহীদুল ইসলাম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদরুদ্দোজা জুয়েল লোহাগড়া উপজেলায় ৬১ সদস্যের একটি পাল্টা কমিটি ঘোষণা দেন। আর ওই কমিটি ঘোষণার দুই দিন পর বহিষ্কৃত হন তাওহীদুল ইসলাম ও বদরুদ্দোজা জুয়েল।
এরপর ২০২১ সালে ২৫ জুন চন্দনাইশ উপজেলা ছাত্রলীগ ও পৌর ছাত্রলীগ এবং পটিয়া উপজেলা ও পৌর ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ। কমিটি ঘোষণা করার পর চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলা ছাত্রলীগের ‘পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। বিক্ষোভকারীরা করছিলেন, টাকার বিনিময়ে ওই কমিটি দেওয়া হয়েছে। যাতে পদবপঞ্চিত হয়েছে অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী।
এছাড়া, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের আওতাধীন বিভিন্ন কমিটির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করতে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। কমিটির সদস্য করা হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সোহাগ ও সহসম্পাদক সোহেল রানা শান্তকে।
দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের আওতাধীন বিভিন্ন উপজেলা, ইউনিয়ন, কলেজসহ ইউনিট কমিটি গঠন করার নামে ছাত্রলীগের নেতারা টাকা লেনদেন করছেন এমন অভিযোগ ছিলো দীর্ঘদিন ধরেই। আবার ছাত্রলীগের কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ারও অভিযোগ উঠেছিল।
যাযাদি/ এসএম