মেহেরপুরে সড়ক উন্নয়নের অজুহাতে আবারও ১৪৪০টি গাছ কাটার পাঁয়তারা

  হুমকির মুখে পরিবেশ

প্রকাশ | ০৪ জুন ২০২৪, ১৩:৩৪ | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১৩:৪৫

গোলাম মোস্তফা, মেহেরপুর প্রতিনিধি
ছবি: যায়যায়দিন

গত বছর মেহেরপুরে সড়ক সম্প্রসারণের জন্য মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কে অন্তত দুই হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটা হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলের বট,পাকুড়, মেহগনি, শিশু, কড়াই, রেইনট্রি, কাঁঠাল, আম, জাম সহ নানা প্রজাতির গাছ ছিল ওইসব সড়কের পাশে। গাছগুলো কাটার ফলে রাস্তার দুই পাশ ফাঁকা হয়ে গেছে। তৈরী হয়েছে মরভূমির পরিবেশ। এই পরিস্থিতির বেশ কাটতে না কাটতেই আবারও সড়ক উন্নয়নের অজুহাতে মেহেরপুর-মুজিবনগর ও মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক মহা সড়কের পাশে আরও ১ হাজার ৪৪০ টি গাছ কাটার উদ্যোগ নিয়েছে মেহেরপুর সড়ক বিভাগ। 

এরইমধ্যে মেহেরপুর জেলা পরিষদ বরাবর একটি চিঠি দিয়ে গাছগুলো কাটার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের আমঝুপি পর্যন্ত চার লেনের রাস্তা তৈরির কাজ করা হবে। যাতে প্রধান বাধা হয়ে আছে রাস্তার পাশে ৯৭৬টি ছোট বড় বিভিন্ন বনজ ও ফলজ গাছ এবং মেহেরপুর- মুজিবনগর সড়কে ৪৬৪টি মোচ ১৪৪০টি গাছ কাটা হবে। এমন খবরে ক্ষোব প্রকাশ করেছে প্রকৃতিপ্রেমী ও পরিবেশবিদরা। 

সরজমিনে সড়ক দুটিতে গিয়ে দেখা গেছে, বট,পাকুড়, মেহগনি, শিশু, কড়াই, রেইনট্রি, কাঁঠাল, আম, জামসহ নানা প্রজাতির  গাছগুলোতে  লাল রং করে নাম্বারিং করা হয়েছে। লাল রং অর্থ হচ্ছে গাছের মৃত্যু পরোয়ানা। দেখা গেছে কিছু গাছ রয়েছে সড়কের একটু উপরে, আবার বেশির ভাগ গাছ রয়েছে সড়কের বাইরে। তবে প্রায় সবগুলো গাছেই নাম্বারিং করা হয়েছে। এসব গাছ গুলো কেটে ফেলার উদ্যোগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে মেহেরপুরের সাধারণ মানুষ। তাদের মতে যদি শতবর্ষি পুরানো গাছগুলো কেটে ফেলা হয় তাহলে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে পরিবেশের উপর। 

গত বছর যে সকল গাছ কাটা হয়েছে ওইসব এলাকা এখন মরুভূমেিতর পরিণত হয়েছে। তার উপরে এবছর তীব্র তাপদাহে মানুষ ও প্রাণিকুলের জীবন ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম হয়েছে। বড় গাছপালা কেটে উজার করার কারণে তাপদাহ আরো বেশি অনুভূত হচ্ছে বলে পারবেশবিদদের দাবি। গাছ, পাহাড়, নদী ও জীব বৈচিত্র পরিবেশের প্রাণ। সেই গাছ নিধন করায় বিপাকে পড়েছে মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতির প্রাণিকুলও। গাছগুলোর নীচে পথচারী ও শ্রমিকরা কাজের মাঝে বিশ্রাম নেয়। 

পশুপাখিদের আবাসস্থল । পাখিকুলের খাদ্যের উৎস এইসব গাছ। পাখিদের কলকাকলিতে মুখর থাকে শতবর্শী গাছগুলো। গাছ কাটার কারনে খাদ্য সংকটে পড়ছে পাখি। গাছ কাটার কারণে বিশুদ্ধ অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত এ অঞ্চলের মানুষ।

মুজিবনগর উপজেলার সদ্যনির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান রাজিব হোসেন বলেন, মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের গাছগুলো কেটে ফেলায় এখন  দিনের বেলা চলাচল করা কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। অথচ বছর খানেক আগেও এই সড়কটি ছিল সবুজে ঘেরা একটি রাস্তা। আবারও মুজিবনগর ও চুয়াডাঙ্গা সড়কের প্রায় দেড় হাজার গাছ কাটার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যদি সত্যই কাটা হয়, তবে তা হবে আমাদের জন্য আত্মঘাতি। 

মুজিবনগরের কেদারগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী আশাদুল ইসলাম বলেন, মেহেরপুরে এবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৩.৭ ডিগ্রি। শত শত বছর ধরে এই গাছগুলো আমাদের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করছে, সেই গাছ গুলো যদি কাটা হয়, আগামী বছর হয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মেহেরপুরে বসবাস করা আরো কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। 

ছহিউদ্দীন ডিগ্রি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাসুদ রেজা যায়যায়দিনকে বলেন, আমরা যে কোন ধরনের গাছ কাটার বিরুদ্ধে। প্রকৃতির প্রধান অনুসঙ্গ হচ্ছে প্রাণ। সেই প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম উপাদন হচ্ছে অক্সিজেন। এই অক্সিজেন আমরা বায়ু মন্ডল থেকে পায়। তবে প্রকৃতির গাছপালা ছাকনি হিসাবে কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করে বিধায় বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণ করে আমরা বেঁচে থাকি। অথচ সেই গাছপালা আমরা অবাধে কেটে ফেলছি। এতে আমরা নিজেরাই আমাদের বাঁচার প্রধান অনুসঙ্গ নির্মল অক্সিজেন গ্রহনের পথ বন্ধ করে দিচ্ছি। আমাদের দাবি নিয়ম অনুযায়ী গাছ যদি কাটতেই হয় তাহলে কর্তনকৃত গাছের দ্বিগুন গাছ লাগাতে হবে। দেশের উন্নয়ন তরান্বিত করার জন্য সড়ক যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবেশকে সুস্থ্য রাখতে গাছের কোন বিকল্প নাই। বর্তমানে পৃথীবিতে অক্সিজেনের কী ভয়াবহ সংকট। এসব দেখেও আমাদের শিক্ষা হয়না। অথচ এই গাছগুলোই নিরবিচ্ছিন্নভাবে আমাদের অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। সড়কের অনেক গাছ বাঁচিয়ে রেখে সড়ক উন্নয়ন করা যায় বলে তিনি মনে করেন।

মেহেরপুর বার্ড ওয়াচিং ক্লাবের সভাপতি এমএ মুহিত যায়যায়দিনকে বলেন, গাছ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী, পাখিদের আবাসস্থল। কোন পাখিই আমাদের নিকট খাদ্য চাইনা। বনের, রাস্তার ধারের ওই গাছগুলো থেকেই তারা খাবার সংগ্রহ করে থাকে। অথচ সেই গাছগুলো সড়ক সম্প্রসারণের জন্য কেটে ফেলা হচ্ছে। আমাদের গাছও দরকার সড়কও দরকার। তিনি এই বর্ষা মৌসুমেই নতুন সড়কের দুপাশে বনবিভাগের মাধ্যমে আবারও গাছ রোপন করার দাবি জানান। 

মেহেরপুর বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক এস.টি হামিম হায়দার যায়যায়দিনকে বলেন, সড়কের দু’পাশে আবারও গাছ রোপন করার জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রস্তাবনা পাঠানো হবে। নির্দেশনা পেলে এসব রাস্তায় নতুন করে গাছ লাগানো হবে।

গাছগুলো কেন কাটা হচ্ছে জানতে চাইলে মেহেরপুর সড়ক বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মিজানুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, গাছগুলো রাস্তার উপরে চলে এসেছে। যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাছাড়া গাছগুলোর কারণে সড়ক সংস্কার বা প্রশস্ত করা যাচ্ছে না। সেজন্য আমরা জেলা পরিষদকে চিঠির মাধ্যমে তালিকা সহ জানিয়েছি। গাছগুলো কাটার ব্যবস্থা করতে বলেছি।   

মেহেরপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুস সালাম যায়যায়দিনকে বলেন, আমরা একটি তালিকাসহ চিঠি পেয়েছি। আমাদের সার্ভেয়ার (পর্যবেক্ষক) যাবে। তারা যেগুলো কাটা প্রয়োজন বলে মনে করবে সেগুলোই কাটা হবে। 

মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. শামীম হাসান বলেন, পরিবেশ সুরক্ষায় গাছ যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র ও এলাকার উন্নয়নে উন্নত যোগাযোগ ব্যাবস্থাও খুব জরুরী। সড়ক নির্মাণ করার পরেও সড়ক ও জনপথের আরো যায়গা থাকছে। সেখানে পূণরায় নতুন করে কিভাবে গাছ রোপন করা যায় সে বিষয়ে বনবিভাগকে উদ্যোগি হতে বলা হয়েছে। 

মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, মেহেরপুর-কুষ্টিয়া, মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর- মুজিবনগর ভায়া দর্শনা সড়কে মানুষের চলাচলে খুব কষ্ট হচ্ছিল। এখন মানুষ বাড়ার সাথে সাথে সরকার যোগাযোগ ব্যাবস্থাও উন্নত করছে। ওইসব সড়ক সম্প্রসারণ করে নির্মাণ করায় কিছু গাছ কাটা পড়ছে। সড়কের কাজ সম্পন্ন হলেই পুণরায় যাতে গাছ রোপন করা হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

যাযাদি/ এসএম