পর্নোগ্রাফি মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি গ্রেপ্তার
প্রকাশ | ২৪ জুন ২০২৪, ১১:৫৪

কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের ভাগিনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি নাজমুল হোসেন হীরা কলেজ পড়ুয়া ২য় স্ত্রীর পর্নোগ্রাফি মামলায় গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
রোববার কিশোরগঞ্জ আমলগ্রহণকারী জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নং- ১ এ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতিসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মামলায় এক নাম্বার আসামি করা হয়েছে সভাপতি মোল্লা সুমনের ভাগ্নে কিশোরগঞ্জ শহরের বয়লা তারাপাশা এলাকার মো. তাজুল ইসলামের ছেলে নাজমুল হোসেন (হিরা) (২৮), দুই নাম্বার আসামি জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন (৩০) ও তিন নাম্বার আসামি সভাপতির বড় ভাই একই এলাকার মো. আশরাফ উদ্দিনের ছেলে মোশারফ হোসেন মোল্লা বাবুল (৪৩)।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ভুক্তভোগী ওই তরুণী কিশোরগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী। বাড়ি হাওরে হওয়ায় কলেজের কাছে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। কলেজে যাওয়া আসার পথে সভাপতির ভাগ্নে হিরা পথরোধ করে প্রায় সময় প্রেম নিবেদন করতেন। এক পর্যায়ে রাজি না হওয়ায় হিরা ভয় দেখায় আমার মামা মোল্লা সুমন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। এই ভয় দেখিয়ে কলেজে যাওয়া আসার পথবন্ধ করে দিবে বলে হুমকি দেয়। এরপর হিরার সাথে প্রেমের সর্ম্পক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে বিবাহের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সর্ম্পক হয়। যা অভিযুক্ত হিরা তার মোবাইল ফোনের মধ্যে স্থিরচিত্র ও ভিডিও ধারণ করে রাখে। এভাবে অনেকদিন অতিবাহিত হলে মামলায় অভিযুক্ত সভাপতি মোল্লা সুমন ও তার বড় ভাই মোল্লা বাবুলকে ফোনে বিষয়টি জানালে তারা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। এই সুযোগে হিরা শারীরিক মিলামেশা অব্যাহত রাখে।
এরপর বিষয়টি মানতে না পেরে আবারও চাপ সৃষ্টি করলে সিরাজ কাজীর মাধ্যমে ২০২৩ সালের ৮ জুন রেজিস্ট্রি করে কিন্তু কাবিনের কোনো কপি তাকে দেওয়া হয়নি। এরপর জানতে পারেন হিরা-এর আগেও বিয়ে করেছেন এবং তার দুইটি সন্তান ছিল পরবর্তীতে তারা মারা যায়। বিষয়টি যেনে তার কাছে হিরার সম্পর্কে নৈতিক চরিত্র অনেক আগে থেকেই খারাপ বলে মনে হয়। মামা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে হিরা। প্রায় সময় তার বাসায় বিভিন্ন মেয়ে নিয়ে শারীরিক সর্ম্পকে জড়ায়।
ভুক্তভোগী তরুণী সহ্য করতে না পেরে হিরাকে মৌখিকভাবে তালাক দিয়ে দূরে সরে যায়। এতেই ঘটে বিপত্তি হিরা তার মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে দুই বারে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেই। আর এ ঘটনায় ভয়ভীতি দেখায় সভাপতি মোল্লা সুমন ও তার ভাই মোল্লা বাবুল। শুধু তাই নয়, টাকা দিয়ে হিরার ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ক্রয় করে। পরবর্তীতে নগ্ন ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মোল্লা সুমন একটি আইফোন ও স্যামসাং মোবাইল নেয়। মোল্লা বাবুলও একই কৌশলে তিন লাখ টাকা নিয়ে মোটর সাইকেল ক্রয় করে। তাতেও থেমে যায়নি অভিযুক্তরা একের পর এক ভয় দেখিয়ে সর্বশেষ চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল হিরা আবারও শারীরিক সর্ম্পক করে ভিডিও ধারণ করে। তাদের ক্ষমতায় শেষ পর্যন্ত আর ঠিকতে পারেনি ভুক্তভোগী ওই নারী। অভিযুক্তদের সাথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় ধারণকৃত সকল ভিডিও, স্থিরচিত্র ও অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। বর্তমানে অসহায় হয়ে সর্বশেষ আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন।
কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা জানান, রোববার হীরার কলেজ পড়ুয়া স্ত্রী কিশোরগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি পর্নোগ্রাফি মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রধান আসামি হীরাকে রাতেই গ্রেফতার করা হয়েছে। অপর দুই আসামি পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।
শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে সভাপতির বিয়েকে কেন্দ্র করে এক তরুণীর সাথে তোলা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যা এখন সকলের হাতে হাতে রয়েছে। যদিও তাদের দাবি এসব গুজব ও মিথ্যা।
বর্তমান কমিটিতে থাকা জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফর রহমান নয়ন বলেন, ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিন সদস্য বিশিষ্ট জেলা কমিটি ঘোষণা করা হয়। প্রায় পাঁচ বছর হয়ে যাচ্ছে এখন পর্যন্ত জেলা কমিটির নেতাকর্মীরা বসতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। বর্তমান সভাপতির ছাত্রত্ব নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। ছাত্রলীগের সভাপতির বিয়ের বিষয়ে অনেক প্রমাণ রয়েছে আমার কাছে, আমাকেও অনেকে বলেছে। মোল্লা সুমন কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার বিএনপি নেতার মেয়েকে বিয়ে করেছে যা সকলের জানা। সে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমি আশা করি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতারা এসব বিষয়ে অবহিত আছেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নিবেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিষয়টি তাদের জানিয়েছে। বর্তমান কমিটির এখন কোন কার্যক্রম নেই। নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে সংগঠনটি।
জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ উমান খান বলেন, সভাপতির বিয়ের বিষয়ে তার কোনো কিছু জানা নেই। তবে একজন ব্যক্তিতো প্রেম করতে পারে। সেটা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতারাই বলে দিয়েছেন। ছাত্রলীগের নেতারা প্রেম করবে এটাই স্বাভাবিক। আর জেলা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে কমিটি করা হবে।
সভাপতির বিয়ের বিষয়টি নিয়ে যখন এতো কিছু তখন সরেজমিনে জানা যায়, কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নে বসবাস ওই তরুণীর পরিবারের। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় ঢাকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকা হয়। ওই তরুণীর সাথে দীর্ঘদিনের প্রেম চলছিল সভাপতি মোল্লা সুমনের। একপর্যায়ে পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে গোপনে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের বিষয়টি যেন জানাজানি না হয় সেজন্য উপস্থিত থাকা ব্যক্তিদের সর্তক করা হয়।
নিজেদের এতো সর্তক থাকার পরও কয়েকদিন আগে ওই তরুণী তার নিজের ফেসবুক ওয়ালে দুইটি ছবি পোস্ট করেন। যেখানে দেখা যায় সভাপতি হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে বসে আছেন। আবার পরক্ষণই ওই তোড়াটা তরুণীর হাতে দিচ্ছেন। এরপর এক এক করে সকলের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায় বিয়ের বিষয়টি।
তরুণীর গ্রামে গেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানায়, প্রায় বছর হতে যাচ্ছে ওই তরুণীর সাথে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের বিয়ে হয়েছে গোপনে। বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখতে চাইলেও সেটি আর গোপন থাকেনি। এখন সকলের জানা হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে কথা হয় ওই তরুণীর সাথে, তার ভাষ্যমতে বিয়ে নয় মোল্লা সুমনের সাথে তার সুসর্ম্পক রয়েছে। যা হৃদ্ধতার সর্ম্পক। আমরা দীর্ঘদিনের পরিচিত। আমার নামে বিয়ের যে কথা ছড়ানো হচ্ছে তা মিথ্যা। ফেসবুকে ব্যবহৃত ছবিগুলোতে কি কোথাও লেখা আছে ওইটা সুমন বা আমাদের বিয়ে হয়েছে। এই গুলো মানুষ গুজব ছড়াচ্ছে। আমি তাদের ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নিব। আমার সম্মান নষ্ট করা হয়েছে। আমার সামনে কয়েকটা পরীক্ষা আছে এই জন্য এখন চুপ আছি, সময় দিতে পারছি না বলে যা খুশি তা করে যাচ্ছে। বিয়ে যখন করবো ধুমধাম করে করবো। প্রশ্ন রাখা হয় আপনি সময় না পেলেও যাকে জড়িয়ে (সুমন) এমনটা করা হচ্ছে তিনি চুপ কেন? তরুণীর পক্ষ থেকে উত্তর আসে উনার (সুমন) সর্ম্পকে আমি বলতে পারবো না। কেন বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছেন না উনি।
এ ব্যাপারে সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন জানান, আমার সাথে ওই তরুণীর প্রেমের সর্ম্পক রয়েছে। এখনও বিয়ে করিনি। প্রেম করাতো আর দোষের না। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রেম করতে পারবে। যা ছড়ানো হচ্ছে সব মিথ্যা। বিয়ে করলে সবাই জানবে।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের ব্যাপারে বিয়েসহ অনেকগুলো অভিযোগ শুনেছি। আমরা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি। প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
যাযাদি/ এসএম