কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে স্মরনকালের ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গেছে প্রায় ৮০ কোটি টাকার মাছ। এবারের বন্যায় এ উপজেলায় সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে মৎসখাত। এ খাতে চাষিরা অপুরনীয় ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন। পুঁজি হারিয়ে সর্বশান্ত কয়েক হাজার চাষী। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মৎস চাষিরা এমন অভিযোগ করেছেন। ক্ষতিগ্রস্থ এসব চাষীরা ছুটছেন উপজেলা মৎস অধিদপ্তরে। ঋনের বোঝা মাথায় নিয়ে দিশেহারা চাষিরা দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন।
উপজেলা মৎস অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ পুকুর/দিঘীর সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৯শ ৪০টি। যার আয়তন প্রায় ৯ শ ৫০ হেক্টর। বানের পানিতে ভেসে গেছে ৪ হাজার মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। চাষাবাদের জন্য মজুদ রাখা প্রায় ৭০ লক্ষ পোনা মাছও ভেসে গেছে পানিতে। পুরো উপজেলায় ক্ষতির পরিমান প্রায় ৮০ কোটি টাকা। তাছাড়া পুকুর/দিঘীর পাড় ভেঙ্গেও অপূরনীয় ক্ষতির সম্মুখিন হযেছে চাষিরা। পুকর, খামার থেকে বের হওয়া এসব মাছ পথে, ঘাটে, রাস্তায় পাওয়া গেছে। খাল বিল নদীতে পানি আর মাছে হয়েছে একাকার।
উপজেলার সিকচাইলের হাসান, হাতিয়ামুড়ীর সাফায়েত, ঠেংগারবামের বেলাল ও পেড়াতলীর মামুনসহ বিভিন্ন এলাকার অন্ততঃ দশজন মৎস চাষীর সাথে কথা হলে তারা জানান, তাদের সব খামার এ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।
বেশিরভাগ মাছচাষি ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন আবার কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে ধারদেনা করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন। হঠাৎ এমন ভয়াবহ বন্যায় নিঃস্ব হয়ে পথে বসতে হবে এমনটি ভাবেননি কেউ। তারা বলেন গত কয়েক বছর এ সময়ে ডাকাতিয়া নদী ও খাল সমূহে হাঁটু পানি ছিলো। টানা বৃষ্টিতে নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হলেও দুশ্চিন্তা ভর করেনি তাদের। দেথতে দেখতেই বন্যার পানিতে ভেসে গেল সবকিছু।
সামিন মৎস খামারের স্বত্তাধিকারী জহির রায়হান এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন মাছ চাষের পাশাপাশি ব্যাংক লোন করে তিনি নিয়েছেন কাজী ফিস ও পোল্ট্রি ফিডের ডিলারশিপ। ওখানে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় আড়াই কোটি টাকা। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মাছ চাষি ও মুরগি খামারিদের খাদ্য সরবরাহ করতেন তিনি।
বন্যায় এ খাতে বকেয়া পড়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা। বাকিতে নেয়া এসব খাদ্যের বকেয়া টাকা মাছ ও মুরগি বিক্রি করে পরিশোধ করার কথা থাকলেও বন্যার পানিতে খামার ভেসে যাওয়ায় টাকা পাওয়া তো দুরের কথা উল্টো তাদের শান্তনা দিতে হচ্ছে। অনিশ্চয়তায় পড়েছে তাদের কাছে পাওনা বকেয়া টাকাও। নিজস্ব মাছের খামার ও বেশ কয়েকটি পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তিনিও প্রায় কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কথা জানান।
এ বন্যায় প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখিন হওয়ার কথা উল্লেখ করে হতাশাগ্রস্থ এ ব্যবসায়ী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন বন্যা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। সবকিছু তকদিরের উপর ছেড়ে দিয়ে হতাশাগ্রস্থ এ ব্যবসায়ী ব্যাংক লোন ও কোম্পানির অপরিশোধিত টাকা পরিশোধ নিয়ে এখন চিন্তিত।
ক্ষতিগ্রস্থ অপর মৎসচাষি আলমগীর হোসেন বলেন এ বন্যায় সর্বস্ব হারিয়েছেন তিনি। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন প্রায় দেড় কোটি টাকার। তিনি সাধ্যের সবটুকুই মাছ চাষের পেছনে ব্যয় করার কথা উল্লেখ করে নিজের কাছে থাকা পুঁজির পাশাপাশি ব্যাংক ও এনজিও থেকে প্রায় সত্তর লক্ষ ঋন নিয়ে এ খাতে বিনিয়োগ করার কথা জানান। তিনি বলেন ৫০ একর জায়গায় ৩টা বেড়ি, ২টা দিঘীসহ কয়েকটি পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। মৎস চাষে অভিজ্ঞতার বর্ননা দিতে গিয়ে তিনি বলেন গত প্রায় ২০ বছর ধরে মৎস চাষের সাথে জড়িত, এমন বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন কখনো হননি। বন্যায় শুধু বিনিয়োগ হারিয়ে সর্বশান্ত হননি তিনি, ধবংশ হয়েছে একটি পরিবারের স্বপ্ন। হতাশাগ্রস্থ চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে এ খামারির।
উপজেলা মৎস কর্মকর্তা তৌহিদ হাসানের সাথে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি ইত্তেফাককে জানান, উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের সকল মৎস খামার বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বানের পানিতে ভেসে গেছে ৪ হাজার মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। চাষাবাদের জন্য মজুদ রাখা প্রায় ৭০ লক্ষ পোনা মাছও ভেসে গেছে পানিতে।
এতে প্রায় ৮০ কোটি টাকার লোকসানের নিচে পড়েছেন এ এলাকার মৎস চাষিরা। উপজেলা মৎস অধিদপ্তর ক্ষতিগ্রস্থ মৎস চাষীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার কথা জানান তিনি।
যাযাদি/ এম