মধুপুরে ফেলনা আনারসের পাতায় উন্নত মানের ফাইবার

প্রকাশ | ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫:৪১

মধুপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
ছবি: যায়যায়দিন

লাল মাটির মধুপুর গড় অঞ্চল আনারসের রাজধানী হিসেবে ইতিহাস ঐতিহ্য খ্যাত। একটি আনারসের গাছে বছরে একবার আনারস আসে। পরের বছর গাছের কান্ড থেকে ও ডাঁটি থেকে চারা বের হয়। মূল গাছে আর আনারস ধরে না। কান্ড থেকে আসা কুশি গাছে ফল ধরে। আর ডাঁটিতে এক সাথে অনেকগুলো চারা আবার আহরোণ করে জমিতে রোপন করা হয়। মূল গাছ অবিক্রিত বা ফেলনা হিসেবে থেকে যায়।

পাতাগুলো মরে নষ্ট হয়ে যায়। এই পাতাকে কাজে লাগিয়ে মধুপুর গড়ে তৈরি হচ্ছে উন্নত মানের ফাইবার। ফাইবারকে কাজে লাগিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে তৈরি হচ্ছে উন্নত মানের পা পোচ, সুতা, ব্যাগসহ নানা শৌখিন তৈজসপত্র। ফাইবার ও শৌখিন তৈজসপত্র যাচ্ছে দেশের বাইরেও। আনারসের পাতাকে ঘিরে গড় অঞ্চলে দেখা দিয়েছে অপার সম্ভাবনা।

ফাইবার তৈরির কাজে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে স্থানীয় বেকার নারী পুরুষ শ্রমিকদের। বৃহৎ পরিসরে এ অঞ্চলের আনারসের পাতাকে কাজে লাগাতে পারলে গড় অঞ্চলে গড়ে উঠতে পারে শিল্প কারখানা। ফাইবারে তৈরিকৃত শৌখিন তৈজসপত্র দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করা যেতে পারে বিদেশেও। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে নতুন দ্বার খুলে যেতে পারে। সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আনারসের পাতাও হতে পারে সুন্দর বনের গোল পাতার মতো ঐতিহ্যবাহী।

আর কৃষি বিভাগ বলছে, মধুপুরে প্রচুর পরিমানে আনারস চাষ হয়ে থাকে। সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ফাইবার তৈরিতে কাঁচামালের কোন অভাব হবে না। হতে পারে স্থানীয় নারী পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান ও বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে ফাইবারে তৈরিকৃত তৈজসপত্র। 

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মধুপুর গড় অঞ্চলের আউশনারা ও মহিষমারা ইউনিয়নে ব্যক্তি উদ্যোগে আনারসের পাতা দিয়ে ফাইবার তৈরি হচ্ছে। ফেলনা পাতা কুড়িয়ে বা বাগান থেকে অটো বাইকে নিয়ে এসে ফাইবার বানানো হচ্ছে। এতে কাঁচামালের কোন অভাব হচ্ছে না। স্বল্প খরচে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে পাতা। কারখানায় এনে গাছ থেকে কেটে পাতাগুলো আলাদা করে মেশিনে দিয়ে ফাইবার পাওয়া যাচ্ছে। তাদের মতে, ফেলনা পাতা দিয়ে উন্নত মানের ফাইবার তৈরি করা যাচ্ছে। শ্রমিক মজুরিও কম। বাড়ির কাছে থাকায় নারীরাও কাজ করে পাচ্ছে মজুরি। সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্প কারখানা স্থাপনের দাবি তাদের। 

সরজমিনে মহিষমারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় আনারসের পাতা দিয়ে আঁশ তৈরি করার দৃশ্য। দূর থেকেই শোনা যায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মতো খটখট শব্দ। চারদিকে টিনের ভেড়া। ভেতরে করা হয়েছে আঁশ বের করার মেশিন। রোদে শুকানো হচ্ছে পাটের মতো সাদা সাদা আঁশ। দেখতে অনেকটা পাটের আঁশের মতো।তবে সাইজে পাটের চেয়ে ছোট। দুই হাত লম্বা সাইজের আঁশগুলো বাঁশের আড়ে শুকানো হচ্ছে। টিনের ঘরে কয়েকজন নারী শ্রমিক আঁশগুলো ময়লা পরিস্কার করে সমান করে কেটে নিচ্ছে। সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখা যায়, ৮ থেকে ১০ টি মেশিনে পাতা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কয়েকবারে বের হচ্ছে আশঁ। পিছনে বসে বসে কয়েক জন নারী শ্রমিক আনারসের পাতা গুলো সুন্দর ভাবে ভাঁজ করে দিচ্ছে মেশিনে থাকা নারী শ্রমিকের হাতে। পাশে কয়েক জন আঁশগুলো হাউজে ধুয়ে নিচ্ছে। পরিস্কার ধুয়ে নেয়া আঁশগুলো রোদে শুকানো হচ্ছে। দারুন কিন্তু সহজেই আনারসের পাতা দিয়ে আঁশ তৈরির এমন দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। 

এ কারখানার মালিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জানালেন, এ আঁশগুলো বায়ারদের কাছে বিক্রি করে। বিদেশ যায় এ আঁশগুলো জানিয়ে বলেন,ছবি তোলা যাবে না। তারমতে, ছবি তোললে এ প্রযুক্তি অনেকেই জেনে যাবে এতে আরো কারখানা গড়ে উঠতে পারে। দাম কত?  কোথায় বিক্রি হয়? এ বিষয় তিনি কোন কথা জানাতে পারবে বলে জানান। 

কারখানার কয়েকজন নারী শ্রমিক জানালেন, বাড়ির কাছে থাকায় তারা কাজ করে। এতে যে মজুরি আসে তা দিয়ে স্বামীর উপার্জনের সাথে যোগ করে সংসার চলে। তাদের মতে, আনারসের পাতা সংগ্রহ থেকে আঁশ তৈরি পর্যন্ত তারা বিভিন্ন ভাগে এক এক জন একেক কাজ করে থাকে। 

স্থানীয়রা জানালেন, ফেলনা আনারসের পাতা দিয়ে আঁশ তৈরি করে জিনিসপত্র স্থানীয় ভাবে তৈরি করা গেলে আরো বহু নারী পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতো। কৃষকরা আনারসের পাশাপাশি পাতারও একটা নূন্যতম দাম পেত। এতে করে ফেলনা পাতা জিনিসপত্র দেশের সীমানা পাড়ি দিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হতো। 

মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রকিব আল রানা জানান, লাল মাটির গড় অঞ্চলে প্রচুর পরিমানে আনারস চাষ হয়। আনারসের পাতা থেকে আঁশ তৈরি করা একটা সম্ভাবনাময় শিল্প। ফেলনা পাতা দিয়ে আঁশ বা সুতা তৈরি করাকে কাজে লাগাতে পারলে আনারসের মতো আঁশও হতে পারে অর্থনৈতিক অপার সম্ভাবনা। এ শিল্পের প্রচুর কাঁচামাল পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে স্বল্প মজুরিতে নারী পুরুষ শ্রমিক। একদিকে বেকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তৈরি হবে আনারসের পাতাকে ঘিরে শিল্পের নতুন দ্বার। আঁশ থেকে তৈরিকৃত শৌখিন তৈজসপত্র বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে। বিদেশে রপ্তানি করে পাওয়া যেতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা। এ জন্য সরকারী বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পেতে পারে আনরাসের পাতা থেকে শিল্পের সম্ভাবনাকেও কাজে লাগানো যাবে। এতে আনারসের মতো মধুপুর গড়ের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে। এমনটাই মনে করছেন এই কর্মকর্তা।

যাযাদি/ এআর