কলেজছাত্র মিলন হত্যার রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তি 

অপহরণের পরপরই হত্যা, লাশ বাইকে নিয়ে ৩০ কিমি 

প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০২৫, ১১:২৫

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
ফাইল ছবি

ঠাকুরগাঁওয়ের কলেজছাত্র মিলন হোসেন অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য উঠে এসেছে, যা ক্রাইম থ্রিলার বা একশন মুভিকেও হার মানায়। হত্যার পরও জীবিত ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে মিলনের পরিবারের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ নেয় হত্যাকারীরা। ইতিমধ্যে পুলিশ সেই টাকার মধ্যে ৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ৫ জন বলে পুলিশ ও গোয়েন্দা সুত্র জানায়। মিলনকে হত্যা করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ছিল বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশের ঠাকুরগাঁও ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) । সবচাইতে লোমহর্ষক  তথ্য হচ্ছে, অপহরণের সাথে সাথে হত্যা করে মিলনের মরদেহকে যাত্রী সাজিয়ে বাইকের মাঝখানে বসিয়ে খুনীরা ৩০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে যায়।  

তিন দিনের রিমান্ড ও সাক্ষীর জবানবন্দি শেষে রোববার (২৩ মার্চ) সকাল ৯টার দিকে  বিষয়টি নিশ্চিত করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের এসআই নবিউল ইসলাম।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, প্রথমে জানা গেছে অপহরণের তিন দিন পর মিলনকে হত্যা করে সেজান-মুরাদ গ্যাং। তবে রিমান্ডে উঠে আসে ঘটনার মূল রহস্য। মিলন হোসেনকে অপহরণ করে হত্যা ও মরদেহ গুম করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। অপহরণের প্রায় ৬ মাস আগে থেকে মিলন ও তার পরিবারের নিয়মিত খোঁজখবর রাখতো ঘাতক সেজান। অপহরণের আগে হত্যার জন্য স্কচটেপ ও মাফলার কেনা ছিলো, লাশ নিয়ে যাওয়ার রুট ও বিকল্প রুটসহ লাশ গুম করার পরিকল্পনা তাদের সাজানোই ছিল।

ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দিতে গিয়ে এই কর্মকর্তা জানান, মিলনকে অপহরণের পরপরই হত্যা করা হয়। মাফলারের সাহায্যে ২ থেকে ৩ মিনিটেই শ্বাসরোধ করে হত্যা করে সেজান ও মুরাদ। শুধু তাই নয়, হত্যার পরে মিলনের লাশকে জীবিত যাত্রী সাজিয়ে মোটরসাইকেলের মাঝখানে বসিয়ে ৩০ কিলোমিটার রাস্তা ঘুরেছে তারা। তবে এ ঘটনায় প্রথমে ৩ লাখের টার্গেট থাকলেও পরে ৩০ লাখ টাকা নেয়ার পরিকল্পনা করে তারা। একটা পর্যায়ে গিয়ে মিলনের পরিবার ২৫ লাখ টাকা দিতে রাজি হয়।

রিমান্ডে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, এরা একটা সংঘবদ্ধ অপহরণকারী অপরাধী চক্র। সাধারণত কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরাই এদের মূল টার্গেটে থাকতো। এ সকল উঠতি বয়সী তরুণদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) প্রেমের ফাঁদে ফেলে ডেকে নিয়ে অপহরণ করে মুক্তিপণের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিতো। প্রথমে শুধুমাত্র সমকামী যুবকদের জন্য ফেসবুকে প্রেমের ফাঁদ পেতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে ছিনতাই ও স্বল্প পরিমাণ অর্থ চাঁদা বা মুক্তিপণ নিতো সেজান ও মুরাদ। একটা সময় তারা ফেসবুকে প্রেমের ফাঁদের চক্রে নারীদেরকেও যুক্ত করে ফেলে। আর এই নারীদের মাধ্যমেও উঠতি বয়সী যুবকদের আকৃষ্ট করতে থাকে। এভাবেই আস্তে আস্তে এই অপরাধ জগতে জড়িয়ে পরে সেজান গ্যাং। শুরুর দিকে প্রতিটি অপহরণের ঘটনায় এক-দুই হাজার উপার্জন হলেও, আস্তে আস্তে তারা লাখ টাকা লেনদেনে অভ্যস্ত হতে থাকে।

নবিউল ইসলাম আরও জানান, মিলনকে অপহরণের ঘটনায় পাওয়া মুক্তিপণের ২৫ লাখ টাকা সেজানের অপরাধ জীবনের সবচেয়ে বড় অংক ছিল। এর আগে ছোট-বড় প্রায় ১০/১২টি অপহরণ ও ধর্ষণের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী এই সেজান। এ সকল ঘটনায় সব মিলিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা মুক্তিপণ হাতিয়ে নিয়েছে সেজান গ্যাং।

ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মিলনকে হত্যার ঘটনায় সরাসরি যুক্ত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মূল আসামি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শীবগঞ্জ মহেশপুর বিটবাজার এলাকার মতিউর রহমানের ছেলে সেজান আলী (২৩) ও আরাজি পাইকপাড়া এলাকার সাইফুল ইসলামের ছেলে মুরাদ(২৫)কে। সেই সাথে ফেসবুকে প্রেমের ফাঁদে সহায়তা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সালন্দর ইউনিয়নের শাহীনগর তেলিপাড়া এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ে ও আসামি মুরাদের ভাগ্নি রত্না আক্তার রিভাকে (১৯)। অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় সহায়তা করার অপরাধে আকচা ইউনিয়ন এলাকার ইলিয়াসের ছেলে মনিরুল (১৭) এবং আলামত গুম করতে জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয় সেজান আলীর মা শিউলি বেগমকে।

আসামিদের তিনদিনের রিমান্ড শেষে আদালতে তোলা হলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করেন। পরে আদালত প্রধান আসামি সেজান আলী ও মুরাদ হোসেনের আরও দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বাকিদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) শেখ জাহিদুল ইসলাম বলেন, কলেজ ছাত্র মিলন হোসেন হত্যার ঘটনায় আমরা এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছি। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। আমাদের টিম কাজ করছে। সেই সঙ্গে ৪ লাখ ৯৭ হাজার টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি টাকা উদ্ধারের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। 

 যাযাদি/ এসএম