এবার পরিবর্তন হলো মুক্তিযোদ্ধার নামে থাকা পাবনা স্টেডিয়াম ও সুইমিংপুলের নাম!
জেলাজুড়ে ক্ষোভ
প্রকাশ | ২৬ মে ২০২৫, ১৫:২৭

সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের সুচিত্রা সেন ছাত্রীনিবাসের নাম পরিবর্তনের রেশ কাটতে না কাটতেই মুছে ফেলা হলো পাবনায় দুই মুক্তিযোদ্ধার নামে করা স্টেডিয়াম ও সুইমিংপুলের নাম। এ নিয়ে জেলা জুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
পাবনার শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনউদ্দিন স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে জেলা স্টেডিয়াম, পাবনা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল সুইমিংপুলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে পাবনা জেলা সুইমিংপুল।
এতে পাবনার মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। রাতারাতি এসব স্থাপনার নাম পরিবর্তন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার অপচেষ্টা বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
জেলা প্রশাসনে পাঠানো যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ের সচিব আমিনুল ইসলাম সাক্ষরিত এক পত্র থেকে জানা যায়, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নির্মিত দেশের বিভিন্ন জেলার স্টেডিয়াম ও সুইমিংপুলের নাম একযোগে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে পাবনার শহীদ আমিনউদ্দিন স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে পাবনা জেলা স্টেডিয়াম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল সুইমিং পুলের নাম পরিবর্তন করে পাবনা জেলা সুইমিংপুল করা হয়।
গত ২৩ মার্চ নেওয়া এ সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকরের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে পাঠানো পত্রে। সম্প্রতি, মন্ত্রনালয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে স্টেডিয়াম ও সুইমিংপুলে নতুন নাম লেখা হয়েছে।
এদিকে ক্রীড়া স্থাপনা থেকে জেলার নেতৃস্থানীয় দুই মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ দেয়ায় প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এ সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য সহ পাবনার সর্বস্তরের মানুষ।
পাবনার সাংস্কৃতিক সংগঠক হাসান মাহমুদ বলেন, 'কয়েকদিন আগে মহানায়িকা সূচিত্রা সেনের নামে এডওয়ার্ড কলেজে ছাত্রীনিবাসের নাম পরিবর্তন করা হলো। সে নিয়ে বলা হলো, পাবনায় এ নায়িকার অবদান কি বা এটা সেটা প্রশ্ন। কিন্তু শহীদ অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিনের ক্ষেত্রে কি বলবেন? কেনো স্টেডিয়াম থেকে তার নাম মুছে দেওয়া হলো? এভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অসম্মানিত করা আগামীর জন্য কোনো ভালো বার্তা বহন করে না। এটি চরম নিন্দনীয় কাজ।'
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা শাওন হোসাইন বলেন, 'একাত্তর আমাদের শেকড় ও চব্বিশ আমাদের অস্তিত্ব। এর কোনোটাকেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু ৫ আগস্টের পর ২৪ এবং ৭১ কে মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটা ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে অপ্রয়োজনীয়ভাবে শহীদ আমিন উদ্দিন স্টেডিয়ামের নাম বদলে দেওয়া হলো। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই। একই সঙ্গে পূর্বের নাম বহালের দাবি জানাচ্ছি।'
পাবনার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ জানান, 'অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে দেশের প্রথম শহীদ এমপি। স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে তিনদিন নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ইতিহাস থেকে মোছা অসম্ভব। আর রফিকুল ইসলাম বকুল দুঃসাহসী ছাত্রনেতা, রণাঙ্গনের যোদ্ধা। বার বার নির্বাচিত এমপি। এদের নাম মুছে ফেলে সরকার কি প্রমাণ করতে চাইছে? মুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুছে দিলেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে যাবে না। এই অন্যায়ের জবাব একদিন জাতিকে দিতে হবে।'
শহীদ আমিন উদ্দিনের সন্তান সদরুল আরেফিন বলেন, 'সরকার রাষ্ট্র পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করছে। আমার বাবা না হয় মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠরা তো রাজনীতি করতেন না। তারা বীরশ্রেষ্ঠদের নামের স্টেডিয়ামেও পরিবর্তন এনেছে? এই সরকারকে আমার কিছুই বলার নেই।'
শহীদ আমিন উদ্দিনের নাতনী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল বলেন, 'শহীদ আমিন উদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ অবদানের কথা সবাই জানে। তার নাম পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত নিন্দনীয় আপত্তিকর। নাম পরিবর্তনের এই রাজনীতি নোংরা সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বহন করে। ফ্যাসিবাদের সময়টার বাইরেও বাংলাদেশের ইতিহাস আছে। নাম পরিবর্তন করে তা মুছে ফেলা যাবে না।'
পাবনা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নূর মোহাম্মদ মাসুম বগা বলেন, 'শহীদ আমিন উদ্দিন পাবনার গর্ব। আমাদের প্রেরণা। মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল পাবনায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী ও গণমানুষের নেতা। বিএনপির সভাপতি হলেও দলমত নির্বিশেষে সবার কাছেই তিনি নিজ গুণে প্রিয় মানুষ ছিলেন। বিএনপির এমপি হিসেবে মৃত্যুবরণ করা এই বীরযোদ্ধার রাজনৈতিক শিষ্য হিসেবে আমি এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। আশা করি শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।'
মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলের সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলাম বলেন, 'নাম পরিবর্তন করে ইতিহাস মুছা যায় না। মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান কোন ভালো ফল বয়ে আনবে না।'
এদিকে নাম পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা তারিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'এই পরিবর্তনের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। কোন প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়নি। আমরা কেবল ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আদেশ অবিলম্বে বাস্তবায়নের নির্দেশনা পালন করেছি মাত্র।'